ভালোবাসার স্ট্যাটাস by আনিসুল হক

ভালোবাসা কি এখন এসে ঠেকল এক দিনের ব্যাপারে? ভালোবাসার স্ট্যাটাস কি এখন পরিণত হয়েছে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে? জানা যাক সাহিত্যিক আনিসুল হকের লেখায়। সেই সঙ্গে রইল তাঁর দেওয়া ভালোবাসার কিছু নমুনা স্ট্যাটাস।

‘আমি বললাম, ‘ফুল।’ তুমি বললে, ‘ও তো কাগজের।’ আমি বললাম, ‘তবু তো ফুল। লোকটা তো কাগজ দিয়ে বন্দুকও বানাতে পারত।’ কবি সমুদ্র গুপ্তর কবিতা, স্মৃতি থেকে আওড়াতে হচ্ছে।
ভালোবাসা জিনিসটা কি এখন এসে ঠেকল এক দিনের ব্যাপারে? ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই শুধু ভালোবাসা হবে। বাকি ৩৬৪ দিন কি তবে মন্দবাসা?
পণ্যবাদী সময়ে বাস করছি আমরা, বিপণিবিতানগুলোয় থরে থরে সাজানো নানা পণ্য, ওসব বিক্রি করতে তো হবে। তাই চাই দিবস! বাবা দিবস, মা দিবস, বন্ধু দিবস, শিক্ষক দিবস। পশ্চিমের দেশগুলোয় এসব দিবসের আগে মার্কেটগুলো সাজানো থাকে উদ্দেশ্যমূলক পণ্যে, বাবাকে কী দেবেন, মাকেই বা কী, তা ওরাই ভেবে রেখেছে, কী বলবেন, সেটা আগেভাগেই রেখেছে লিখে। পয়সা দিলে সেসব আপনার বাবা, মা, বন্ধু, প্রেমিকা, শিক্ষকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও ওদেরই।

তবু ভালো যে একটা দিন ভালোবাসা দিবস পালন করা হচ্ছে। ওরা তো ঘৃণা দিবসও পালন করতে পারত।
এই জগৎ চলছেই ভালোবাসার টানে, নীল আকাশ, অগণন নক্ষত্র, চাঁদের আলো, সবুজ পাতা, রঙিন ফুলে ভালোবাসাই প্রকাশিত হচ্ছে দিবস-রজনী। তবু এই নিখিল ভালোবাসা এখন কি এসে আশ্রয় নিল মুঠোফোনে, বুড়ো আঙুলে লিখে চলা এসএমএসে কিংবা স্ট্যাটাসে, আইপ্যাডে, ল্যাপটপে, ডেস্কটপের ১৪ ইঞ্চিতে! ভালোবাসার স্ট্যাটাস কি এখন পরিণত হয়েছে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে?
নারী-পুরুষের মধ্যে কী যে এক দুর্নিবার টান, তার ব্যাখ্যারও কোনো শেষ নেই। কবিরা কবিতা লিখে, শিল্পীরা ছবি এঁকে, গায়কেরা গান গেয়ে, বিজ্ঞানীরা নিরীক্ষা করে কোটি কোটি পাতা লিখলেন। তবু কি ব্যাখ্যা পাওয়া গেল?
প্রেম বা ভালোবাসা জিনিসটা আসলে ব্যাখ্যা করার নয়। এমনকি প্রেম করারও নয়, এটা হয়ে যায়। সবারই জীবনে প্রেম আসে। প্রেম আসুক বা না আসুক, ভালোবাসাকে জগতের সবাই ভালোবাসে। তাই তো যেকোনো গানেই শুধু তুমি আর আমি... তুমি আর আমি ছাড়া নাকি গান হয় না, কবিতা হয় না, শিল্প-সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে প্রেম ছিল, আছে, থাকবেও হয়তো।
ফেসবুকের স্ট্যাটাসের বড় অংশ জুড়ে তাই ভালোবাসা। আমার তরুণতর বন্ধুরা, সহকর্মীরা, ভ্রাতুষ্পুত্রীরা অর্ডার দিয়ে রেখেছে, আপনি প্রেমের কবিতা দেবেন স্ট্যাটাসে। আমরা সেটা শেয়ার করব। উৎসাহ পেয়ে লেগে যাই।
সকালবেলা লিখি:
বারান্দাতে অলকানন্দাগুচ্ছ,
জানান দিল এখনো তুমি ঘুমুচ্ছ।
আকাশে চাঁদ উঠেছে, পূর্ণিমায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। আমাকে বসে বসে স্ট্যাটাস লিখতে হচ্ছে:
আমি যখন চাঁদের নিচে দাঁড়াই,
মুগ্ধ, কাঁপি, তোমাকে খুব হারাই।
তারপর চাঁদ দেখব কী, একটু পর পর ফেসবুকেতে নোটিশ দেখি, কটা লাইক পড়ল। গবেষকেরা বলছেন, ফেসবুক হলো আত্মপ্রেমের চূড়ান্ত কারখানা, যে বেশি ফেসবুকিং করে সে নার্সিসিজমে ভোগে। হবেই হয়তো। আমার মতো আত্মপ্রেমিক তো আমি কাউকে দেখি না। আমাদের এক বন্ধু বইমেলা উপলক্ষে নিজের বইসংক্রান্ত স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, ভাইরে, বই কিনতে হবে না, আমি চাই লাইক। এই স্ট্যাটাসে একটা লাইক দিন।
তবু বলি, দিন যতই পাল্টাক, নারীপুরুষের যোগাযোগের মাধ্যম যতই সহজ হোক, যত সহজেই ছেলেটি মেয়েটির হোস্টেলে ঢুকে পড়তে পারছে মোবাইলে-ফেসবুকে, ভালোবাসার রহস্যটা তত উন্মোচিত হয়ে পড়েনি। এখনো রবীন্দ্রনাথই ভরসা:
সখী ভালোবাসা কারে কয়?
সে কি কেবলই যাতনাময়?
সে কি কেবলই চোখের জল
সে কি কেবলই দুখের শ্বাস
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ?
কিংবা তারাশঙ্করের কবি থেকে যখন কেউ স্ট্যাটাস দেয়, যে যাহারে ভালোবাসে, সে তাহারে পায় না কেনে, বুকটা কেন যে মোচড় দিয়ে ওঠে।
এই ভালোবাসা দিবসে ‘একজন বন্ধু চাই’ জাতীয় বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহার করতে পারেন, এ রকম দু-চারটা স্ট্যাটাস আমি রচনা করে দিই।
১. একা আছি ভালোই আছি,
বকছি কত আবোল তাবল,
তোমায় পেলে ভালোই হতো!
জোছনা গোলাপ সবই ডাবল।
২. তোমার জন্য জন্মেছিলাম
তোমার জন্য হলাম বড়,
তোমার জন্য মরছি আমি,
ইনবক্সে মেসেজ করো।
৩. ভালোবাসা দিবসে
একা থাকবে কি বসে?
৪. আজ সারা দিন তোমায় নিয়ে ভাবব
আজ সকালে এটাই আমার কাব্য
একবার একেবারেই রোমান্টিক কয়েকটা পঙিক্ত লিখে বেশ লাইক পেয়েছিলাম:
যদি কাউকে না বলিস
তোকে একদিন দেখাতে নিয়ে যাব
কাউকে বলবি না
আমি একটা সমুদ্র গড়ছি
একটু একটু করে
অনেকটা হয়ে গেছে খোঁড়া...
যদি কাউকে না বলিস একদিন তোকে ওই দ্বীপেও নিয়ে যাব...
মাত্র দুদিন আগের ঘটনা। বইমেলায় এক ভদ্রলোক দুটো বাচ্চা নিয়ে এসেছেন। অহনা আর মোহনা। দুটো বই নিলেন। দুটো অটোগ্রাফ দুই মেয়ের জন্য। তারপর ‘ফাঁদ’ বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা শেলীর জন্য। ওদের মা। তিনি আমাকে এই বইটা উপহার দিয়েছিলেন অনেক বছর আগে।’
আমি বললাম, তিনি কই?
‘তিনি মারা গেছেন। ক্যানসারে।’
আমি কী লিখব? আমি কী লিখব? শেলী আপা! শেলী ভাবি! আপনি কোথায় আছেন? কেমন আছেন? আপনার স্বামী আজও আপনাকে মনে রেখেছেন। ‘ফাঁদ’ বইটা দেখলে আপনার কথা তাঁর মনে পড়ে। বইমেলা দেখলে আপনার কথা মনে পড়ে। আহা রে, বাচ্চা দুটোর মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না। আমরা কিছুই লিখিনি, তারাশঙ্করের কবি নিতাই যা লিখেছেন,
ভালোবেসে মিটিল না সাধ
কুলাল না এক জীবনে।
হায়রে জীবন এত ছোট কেনে?
আমি পাষাণ, আমি বুক বেঁধে রেখেছি, আমাদের বন্ধু তাপসের কথা আমি বলতে পারব না, আহা রে আগামী সোনা, ফুলের মতো বাচ্চাটা, তোমার মামণি নীতা গান গাইত, ও তোতাপাখি রে, শেকল খুলে দিতে পারি আমার মাকে যদি এনে দাও... তোমার মামণি আকাশের তারা হয়ে গেছেন, গত বছর এমনি সময়ে তোমরা এসেছিলে ঢাকায়, বইমেলা করতে, শাহবাগ করতে, তোমরা বাবা-ছেলে ফিরে গেলে, মা ফিরলেন না, বাংলাদেশের আকাশে তারা হয়ে রইলেন...গত মে মাসটা আমি তোমাদের বাসায় আমেরিকায় ছিলাম, সেদিনও তুমি ফোন করে বললে, ‘আনিশ চাচ্চু, তুমি কই, আই ওয়ান্ট টু সি ইউ...।’ তাপস ফেসবুকে নীতার ছবিগুলো দিচ্ছেন, আজ ইনবক্সে পাঠিয়েছেন নীতার জন্য গানের সিডির প্রচ্ছদ...
আমার চোখ ভেসে যায়, আমার বুক ভেঙে যায়। জীবন এত ছোট কেনে? জীবন এত ছোট কেনে?
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger