বাঘা তেঁতুল- ক্যাশ by সৈয়দ আবুল মকসুদ

পারস্যের কবি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ওমর খৈয়াম বলে গেছেন: ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতায় শূন্য থাক...’।
ওমর খৈয়াম তাঁর রুবাইগুলো লিখেছিলেন এই ভেবে যে তাঁর মৃত্যুর হাজার বছর পরেও কোনো কোনো দেশের মন্ত্রী-সাংসদের এই উপদেশের প্রয়োজন হবে। নগদ টাকাকেই বলা হয় ক্যাশ। ইংরেজি শব্দ ক্যাশের অর্থ হলো ধাতব মুদ্রায় বা কাগজের নোটে বিনিময়যোগ্য টাকা।
বহুকাল থেকেই এই উপমহাদেশে কৃতী ব্যক্তিদের সংবর্ধনা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সেই ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রবল বেগে আজকাল সরকারি দলের কৃতীদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। সংসদের চিফ হুইপকেও তাঁর এলাকার মানুষ গণসংবর্ধনা দেন। সংবর্ধনায় উপঢৌকন গ্রহণ করতে করতে ক্লান্ত মাননীয় চিফ হুইপ মাইকে ঘোষণা দেন: ‘আগামীকাল দলীয় কার্যালয়ে সকাল নয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত বসব। যদি কেউ [কারও] উপঢৌকন দেওয়ার ইচ্ছা থাকে, তবে আর এই ক্রেস্ট না, ক্যাশ চাই, ক্যাশ। বোঝেন নাই? নির্বাচন করতে গেলে অনেক টাকা লাগে। কাজেই ক্যাশ দিয়েন, খুব ভালো হইবে। কাল দেখা হবে সবার সঙ্গে। আজ আর কোনো ক্রেস্ট নেব না। সমস্ত ক্রেস্ট আমি পরে নেব।’ [সমকাল]
সংবর্ধনার শুভসংবাদ কাগজে ছাপা হওয়ার পর তিনি নাখোশ হন। বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন: ‘সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য ২৫-৩০ হাজার লোক জমায়েত হয়েছিল। উন্মুক্ত ময়দানে আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে কেবল ফুল ও ক্রেস্ট গ্রহণ করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। অন্ধকার নেমে এলে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে—এই তাগাদা থেকে...গল্পচ্ছলে ফুল ও ক্রেস্টের পেছনে অর্থ খরচ না করে দলের কাজে অর্থ ব্যয়ের পরামর্শ দিই।’ তিনি বলতে চেয়েছেন, দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকেরা এই রিপোর্ট করায় তাঁর সম্পর্কে ‘মিস ধারণা’-র সৃষ্টি হয়েছে ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে’।
মানবেতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচনের পরে মন্ত্রী-সাংসদদের সংবর্ধনার জ্বরে সমগ্র দেশ ভুগছে। এর একটি সমাজতাত্ত্বিক তাৎপর্য রয়েছে। ক্রেস্ট-প্রত্যাশীদের সমালোচনা করছে মিডিয়া, কিন্তু ক্রেস্ট প্রদানকারীরা থেকে যাচ্ছেন সমালোচনার ঊর্ধ্বে। সমাজবিজ্ঞানের আলোকে বিষয়টির বিচার-বিশ্লেষণ না করলে মাননীয়দের প্রতিও করা হবে অবিচার, আর যে ভক্তকুল ফুল, ক্রেস্ট ও ক্যাশ নিয়ে ছুটছেন সংবর্ধনাস্থলে, তাঁদের প্রতিও করা হবে না সুবিচার।
এই যে ২৫-৩০ হাজার মানুষ গভীর ভালোবাসা থেকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা দিতে সভাস্থলে ছুটে যান, তাঁদের কি কোনো কাজকাম নেই? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ও তালেবেলেমরা গেল। তাদের শিক্ষকেরা মহান পেশা ফেলে ছুটলেন। কৃষকেরা তাঁদের খেতখামার ফেলে গেলেন। কৃষিশ্রমিকেরা—যাঁদের ক্যাশ ও কাইন্ড কোনো কিছুই দেওয়ার সামর্থ্য নেই—তাঁরাও জমিতে মই বা নিড়ানি দেওয়া বাদ দিয়ে গেলেন। কামারের হাপরে সেদিন জ্বলেনি আগুন, কারণ তাকেও যেতে হয়। কুমার তার হাঁড়ি-পাতিল বানানো বাদ দিয়ে গেলেন ওই মহতী অনুষ্ঠানে। তাঁতিদের বাড়িতে সেদিন মাকুর খটখট শব্দ হয়নি। জেলেরা যাননি বিল-বাঁওড় ও নদীতে মাছ ধরতে। এলাকার সৎ ও কর্মঠ সরকারি-আধা সরকারি কর্মকর্তাদের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অফিসের কাজ ফেলে গণসংবর্ধনায় না গেলে পক্ষকালের মধ্যে সোজা বান্দরবান বা খাগড়াছড়ি।
এ ধরনের আয়োজনে যাওয়া না-যাওয়ারও তাৎপর্য বিরাট। ওই দিনই কারও বিয়াইবাড়ি পিঠা নিয়ে যাওয়ার কথা। সারা রাত গিন্নি পিঠা বানিয়েছেন। গৃহকর্তা সংবর্ধনায় না গিয়ে পিঠার পাত্র নিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যান। যৌতুকের ব্যাপারে এমনিতেই ঝামেলায় আছেন।
কিন্তু জমির সীমানা নিয়ে তাঁর সঙ্গে যাঁর বিবাদ চলছে, তিনি তাঁর এই অনুপস্থিতির সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন। পরদিনই বাজারে গিয়ে নেতার কোনো চামচাকে বলবেন, ওই লোকটি বা তার বাবা একাত্তরে খানসেনাদের ক্যাম্পে ভুনা খিচুড়ি আর মুরগির ছালুন সাপ্লাই দিত। আর একটু নির্মম হলে বলবেন, মেয়েলোক সাপ্লাই দিত। সুতরাং এ-জাতীয় সভায় না যাওয়ার স্পর্ধা কার?
আখেরি জামানা বা কলিকালে সবকিছুই উল্টে গেছে। আগের দিনে কেউ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলে তিনি এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতেন। যিনি তাঁকে ভোট দেননি, তা জানা সত্ত্বেও, তাঁকে দেখে বলতেন, চাচা, আপনাদের ভোটেই আজ আমি এমপি। দোয়া করবেন। এখন মাননীয়রা নির্বাচনের পর ভোটারদের হুকুম করেন, নির্বাচন করতে এত্ত টাকা লাগে। ব্যাটা ভোট দিয়েছিস তো কী হয়েছে? ক্যাশ দে। বঙ্গীয় গণতন্ত্রের মর্মবাণীই: ক্যাশ।
মধ্যযুগের বাঙালি কবি বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। বঙ্গীয় গণতন্ত্রের মর্মবাণী: সবার উপরে ক্যাশ
সত্য তাহার বাইরে নাই। গত নির্বাচনের প্রার্থীদের ক্যাশের ও সম্পদের কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া গেছে। এখন মাইক থেকে ঘোষণা হচ্ছে: ক্যাশ চাই, ক্যাশ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger