বিদায় ২০১০। স্বাগত ২০১১। ভালয় মন্দয় কেটেছে আমাদের গত একটি বছর। এর চেয়ে যেন ভাল কাটে নতুন বছরটি। আমাদের আশা এই একটিই। মার্কিন প্রবচনবিদ উইলিয়াম আথার ওয়ার্ড (১৯২১-১৯৯৪)-কে অনুসরণ করে এ দিনটিতে বলতে ইচ্ছা করে আহা আরও একটি বছর এলো জীবনে। মনে হয় বাঁচবো আরো একটি বছর।
তাই আর দুশ্চিন্তা নয়, ভয় আর সন্দেহ নয়। অন্তরের সব সাধ নিয়ে যথাসাধ্য করে যাবো এবার । এখন থেকে প্রতিটি দিন বাঁচবো হাসি-আনন্দে, সৃষ্টিতে-সাধনাতে থাকবো মনেপ্রাণে মগ্ন। আরো একটি বছর মানে আরো অনেক সুযোগ। সেসব সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এবার শুদ্ধ করে নেবো সব ভুল, কাজ করে যাবো শান্তির জন্য। অন্তত একটি গাছের চারা লাগাবো পথের ধারে, আর আগের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দে চলবো-বলবো-গাইবো!
গত বছরের অভিজ্ঞতা যা হোক, নতুন বছর শুরুর এই দিনগুলোতে নানা আশা জাগে আমাদের মনে, আমরা ভরসাও করি নানা কিছুতে। বিশেষ করে নিজেদের উদ্যমের ওপরই আস্থা রাখি বেশি। মনে পড়ে স্কুলজীবনে পাঠ্যপুস্তকে পড়া কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪)-এর "জয়যাত্রা" নামের কবিতাটির কয়েক পঙক্তিঃ
যাত্রা তব শুরু হোক হে নবীন, কর হানি' দ্বারে
নবযুগ ডাকিছে তোমারে।
তোমার উত্থান মাগি' ভবিষ্যৎ রহে প্রতীক্ষায়
রুদ্ধ বাতায়ন পাশে শঙ্কিত আলোক শিহরায়!
সুপ্তি ত্যাজি' বরি' লও তারে, লুপ্ত হোক অপমান,
দেখা দিক শাশ্বত কল্যাণ।
তবুও পুরনোকে ফেলে না দিয়ে, ভুলে না গিয়ে তার মূল্যায়ন-বিশেস্নষণ করে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে সামনে এগিয়ে যাওয়া ভাল। এজন্যই প্রয়োজন ফিরে দেখা। সে দেখা একবার নয়, মাঝে-মধ্যেই দেখা দরকার। গত বছর কি চেয়েছিলাম, কি পেয়েছি আর কি হারিয়েছি তা নতুন বছরের শুরুর এই সময়টাতেই মনে পড়ে বেশি-বেশি। আমার ভাবনায় এই হারিয়ে যাওয়াদের অ্যালবামটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে বারবার। এ বছর অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছি বলেই হয়তো এমন হয়। প্রথমেই বলতে হয় কবি ও বহুমাত্রিক লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দের বিদায়ের কথা। এত আকস্মিক তাঁর বিদায় যে বেদনার্ত হওয়ার চেয়ে আমি বুঝি বিমূঢ়ই হয়েছি বেশি। আমার চেয়ে বয়সে ছিলেন কিছু বড়, সাহিত্যিক যাত্রাতেও ছিলেন একটু আগে তবে নানা দিক দিয়ে অত্যন্ত কাছাকাছি ছিলাম আমরা। বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি তাঁর সঙ্গে আমার অমিলের চেয়ে মিল-ই বেশি। আমাদের বাসাও কাছাকাছি। তাই দেখাও হতো মাঝে-মধ্যে। আর ফোনে তো কথা হতোই। মৃতু্যর মাত্র ক'দিন আগে কথা হয়েছিল একটি লেখার সূত্রে। তাঁকে যে প্রাবন্ধিক-গবেষক নয়, মূলত কবি হিসেবে আমি মূল্যায়ন করি তা তিনি জানতেন। তাঁর মৃতু্যর পর এক শোকনিবন্ধ লিখেছিলাম পত্রিকায়। সে লেখাটির শুরু ছিল এ রকম:
"আবদুল মান্নান সৈয়দকে প্রথম দেখি ১৯৬৪ সালের শেষদিকে। তখন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের পাট শেষ। শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনের সামনে খোলা ঘাসের চত্বরে বসেছিলেন তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক স্যাড জেনারেশনের কবি-লেখকরা। স্যাড জেনারেশনের মুখপত্রে লেখেননি এমন ক'জন এবং বাইরের বন্ধু-বান্ধবও ছিলেন দু'-একজন। তাঁদের অনেকেই আজ আর নেই। যেমন: আফজাল চৌধুরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ইউসুফ পাশা, ইনামুল কবির ব্র?হ্মা, মাহবুবুল আলম জিনু। এখনও আছেন রফিক আজাদ, বুলবুল খান মাহবুব, প্রশান্ত ঘোষাল, মুহম্মদ মোজাদ্দেদ, রণজিৎ পাল চৌধুরী। মান্নান এসেছিলেন সবার শেষে। সন্ধ্যা ঠেকিয়ে। পরনে খুব অাঁটোসাঁটো টেডি প্যান্ট, বেল্ট, ইন করা ফুলেল ফুল শার্ট। সেখানে ও রকম টেডি প্যান্ট পরা ছিলেন আরো দু'জন _ রফিক আজাদ ও ইউসুফ পাশা।"
এখানে উলিস্নখিত মুহম্মদ মোজাদ্দেদও বিদায় নিয়েছেন এ লেখার কিছুদিন পর, গত ২৬ নভেম্বর। তিনি পরিচিত ছিলেন 'দাদু' নামে। সম্ভবত আড্ডার সবার চেয়ে বয়সে বড়, কিছুটা গাম্ভীর্যমণ্ডিত ও স্বল্পভাষী ছিলেন বলে সম্বোধিত হতেন ওই রকম একটি নামে। ছাত্রজীবনে থাকতেন ঢাকা হলে। রুমমেট ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরীর। ১৯৬৪ সালের প্রথমদিকে একবার দুপুর বারোটায় তাঁদের রুমে গিয়ে দু'জনকে দেখেছিলাম গভীর ঘুমে মগ্ন।
মুহম্মদ মোজাদ্দেদ কখনও কিছু লিখেছেন কিনা জানি না, তবে স্যাড-স্বাক্ষর গোষ্ঠীর আড্ডা ও অন্যান্য তৎপরতায় তিনি ছিলেন অপরিহার্য। সবখানেই তাঁর মতামতের ছিল বিশেষ গুরুত্ব। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞ মানতাম তাঁকে। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত "স্বাক্ষর"-এর তৃতীয় সঙ্কলনের প্রকাশক ছিলেন তিনি। তখন তাঁর ঠিকানা ছিল "২৫৭ নং এলিফ্যান্ট রোড, সাউথ ধানমণ্ডী"।
১৯৯৫-২০০৪ সালে প্রায় সকালেই তাঁর সঙ্গে দেখা হতো আমার। অফিসের গাড়িতে তিনি যেতেন কর্মস্থল বাংলা একাডেমী, আমি যেতাম বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট। দেখা হওয়া মাত্র হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠতেন, হাত নাড়তেন। সেই হাসি, হাত নাড়া মনে আছে। মনে থাকবে।
তারপর গাড়ি করে অফিসে যাওয়া নেই ছ'-সাত বছর হলো। মুহম্মদ মুজাদ্দেদের সঙ্গেও দেখা নেই আর। হঠাৎ করে সেদিন বাসা থেকে বেরোতে গিয়ে এক কালো গাড়ির মুখে পড়ে যাই। দেখি বসে আছেন তিনি। বয়সের ছাপ সর্বাঙ্গে। ভাবি, আমাকে চিনবেন কিনা। কিন্তু 'দাদু' বলে যেই ডেকেছি অমনি সেই আগের মতোই উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন হাসিতে। এর ক'দিন পরেই পত্রিকায় পড়ি তাঁর মৃতু্য সংবাদ। খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারি, ষাট দশকের সুহূদ স্বজন অনেকেই জানতে পারেননি তাঁর বিদায়ের খবর। এ রকম নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছেন নিভৃত স্বভাবের কবি,কথা-সাহিত্যিক আনোয়ারা রহমান এ্যানা। তিনি ছিলেন কবি-সমালোচক আতাউর রহমানের (১৯২৫-১৯৯৯) স্ত্রী। গত ১৬ ডিসেম্বর তাঁর মৃতু্যর খবর মাত্র একটি পত্রিকায় দেখেছি আমি। আনোয়ারা রহমান এ্যানার একমাত্র উপন্যাস "আমার বঁধুয়া" প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। এরপর কবিতা ও ছোটগল্পই লিখেছেন তিনি। তবে সেসব বই প্রকাশিত হয়েছে যৌথভাবে। কয়েকটি সঙ্কলন সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
নাট্যকার সাঈদ আহমদকে আমরা হারিয়েছি গত বছরের শুরুতে_ ২১ জানুয়ারি। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম ১৯৭৭ সালে, কবি শামসুর রাহমানের মাধ্যমে। পরিচয় অবশ্য লেখালেখির সূত্রে। তাঁকে নিয়ে আমি লিখেছিলাম "বিচিত্রা"য়। ১৯৭৫ সালে নাটক বিভাগে বাংলা একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার পেলেও সাঈদ আহমদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে সম্ভবত সেটিই প্রথম কোনও লেখা। পরে তাঁর "প্রতিদিন একদিন" (১৯৭৫) নাটকটি আমি মঞ্চায়নের উদ্যোগ নেই বহুবচন নাট্যগোষ্ঠীর মাধ্যমে। পরে মজিব বিন হকের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়েছিল নাটকটি। ১৯৯২ সালের অক্টোবরে সাঈদ আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম ভারতে অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক সাংস্কৃতিক উৎসবে। ওই দলের সাহিত্য বিভাগে আরো ছিলেন আসাদ চৌধুরী ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। মনে পড়ে আমাদের কলকাতা, বেঙ্গালুরু, তিরুবানন্তপুরম্ ভ্রমণ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা।
সাঈদ আহমদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা তাঁর মৃতু্যর মাত্র কয়েক মাস আগে। তিনি এসেছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবে_ ক্লাবের পক্ষ থেকে দেয়া লেখক-সাহিত্যিকদের সংবর্ধনা গ্রহণ করতে। বরাবরের মতো সেদিনও ছিলেন কৌতুকসি্নগ্ধ ঢাকাইয়া ভাষায় রস-রসিকতায় উজ্জ্বল। মনে পড়ছে, সুতলি কাবাব দিয়ে বাকরখানি খাওয়ার মজাটা আমাকে শিখিয়েছেন তিনিই।
আমার প্রিয় লেখকদের একজন আবু রুশদ আমাদের ছেড়ে গেছেন গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনও, তবে তাঁর ভক্ত ছিলাম সেই ষাটের দশকের প্রথমদিক থেকে। ভক্তির শুরু তাঁর উপন্যাস "এলোমেলো" (কলকাতা, ১৯৪৬) পড়ে।
আবু রুশদ ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডমীর সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ছোটগল্প বিভাগে। রহস্যজনক কারণে সারাজীবন "আবু রুশদ" নামে লিখলেও ওই পুরস্কার তাঁকে দেয়া হয়েছে "সৈয়দ আবু রুশদ মতিনউদ্দিন" নামে। এখনও বাংলা একাডেমীর বিভিন্ন প্রকাশনায় তাঁর নাম উলেস্নখ করা হয় "আবু রুশদ মতিনউদ্দিন" হিসেবে। উলেস্নখ্য, ১৯৬০-'৬৭ সালে বাংলা একাডেমীর পরিচালক ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান।
সাংবাদিক-ব্যক্তিত্ব আখ্তার-উল্-আলম মারা গেছেন গত ২৪ জুন। দৈনিক ইত্তেফাকে তাঁর দীর্ঘ উপ-সম্পাদকীয় এক সময় ছিল ব্যাপক আলোচিত। ওইসব উপ-সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত মতামতের পক্ষে-বিপক্ষে তর্কও হতো খুব। আমিও অনেক বিষয়ে একমত হতে পারিনি তাঁর সঙ্গে, তবে একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম তাঁর তথ্যপূর্ণ লেখার। আখতার-উল-আলমের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনও। একবার ফোনে কথা হয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। কথার শেষে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের। কিন্তু সে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারিনি কি এক ব্যস্ততায়। সেই না পারার দুঃখ আমার রয়ে গেছে এখনও।
সাংবাদিক প্রফুলস্ন কুমার ভক্তকে হারিয়েছি গত ৪ অক্টোবর। তিনি আমার সহকমর্ী ছিলেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৮৪ সালে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সম্পর্কে তাঁর কয়েকটি রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে একাধিক নিবন্ধ লিখেছিলাম সম্পাদকীয় স্তম্ভে। কিছু কাজ হয়েছিল তাতে। অন্তত আসন্ন বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
রাজনীতিবিদ আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার বিদায় অত্যন্ত দুঃখপূর্ণ হয়েছে আমাদের জন্য। একদিকে গুরুতর অসুস্থতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক জীবনের ওলট-পালট বিপর্যয়ের মধ্যে এক ট্র্যাজিক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে তাঁকে।
ষাটের দশকের উত্তাল ছাত্র-রাজনীতির সূত্রে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, মান্নান ভুঁইয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। পরিচয়ের সূত্র ছিলেন অবশ্য কবি-রাজনীতিক বুলবুল খান মাহবুব। তাঁরা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গণআন্দোলনের দিনগুলোতে তিনিও এক অগ্রজ বন্ধু হয়ে ওঠেন আমার। পরিচয়ের সূত্র ছিল অবশ্য আরো একটি। আমার পিতামহ দেলদুয়ারের পীরসাহেব শাহ সুফি মোহাম্মদ আবদুর রকিব জীবনের শেষ কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন নরসিংদী, শিবপুর, ভবানীপুর অঞ্চলে। ওখানে অনেক মুরিদ ছিলেন তাঁর, এখনও আছেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মান্নান ভুঁইয়ার পরিবারের সদস্য ও অন্য আত্মীয়-স্বজনও। তিনি আদর্শবাদী রাজনীতিক ছিলেন কিন্তু নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন আদর্শহীন রাজনীতির মধ্যে। তা-ই ছিল তার জন্য বেশি দুঃখপূর্ণ। দু'-একবার ডেকেছিলেন, দু'-একবার নিজে থেকেও গেছি তাঁর ওখানে। তখন তাঁর আশপাশে দেখেছি একশ্রেণীর ট্যান্ডলদের ভিড়। ওই ভিড় ভাল লাগেনি আমার। তবে আদর্শবাদী রাজনীতিবিদদের মধ্যে যাঁরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল থাকতে পেরেছেন তাঁদের একজন দেওয়ান ফরিদ গাজীকে আমরা হারিয়েছি গত বছর। মনে পড়ে ২০০২ সালে এক অনুষ্ঠানের সূত্রে সিলেটে গিয়ে একদিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে পেরেছিলাম তাঁর সানি্নধ্যে। তাঁর লামাবাজারের সাধারণ, ছিমছাম কিন্তু ঐতিহ্যমণ্ডিত বাড়িতে অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। কথায় কথায় জেনেছিলাম, শিখেছিলাম কত কিছু। সেসব কথায় রাজনৈতিক বিষয়াদিই ছিল মুখ্য। তবে আমি টাঙ্গাইলের জেনে তিনি বিশেষভাবে কথা বলেন আবদুল মান্নান ও কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে। মুক্তিযুদ্ধে দু'জনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান যে এখনও সেভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না তা তিনি বলেন দুঃখের সঙ্গে। নিজের সম্পর্কে বলেন, আমি সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের মধ্যেই মিশে থাকতে চাই। আমি আলাদা কোনও পরিচয় নিয়ে আলাদা হয়ে থাকতে চাই না। পরে একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, আমার জীবনের প্রার্থনা এটাই। সেই থেকে ওই কবিতাটিও প্রার্থনা হয়ে আছে আমার।
আসুন, আজ এক বর্ষকে বিদায় জানিয়ে আরেক বর্ষকে স্বাগত জানানোর মুহূর্তে আমরা সকলে মিলে পাঠ করি শেখ ফজলুল করিম-এর "প্রার্থনা" নামের সেই কবিতাটি:
প্রভু, করো মোরে শস্যশ্যামল সমতল মাঠ
করিও না তুঙ্গশির গিরি;
ক্ষুধিত আমাতে যেন পায় গো আহার,
ক্ষুণ মনে নাহি যায় ফিরি'।
লবণ-সমুদ্র তুমি করিও না মোরে
করো দেব, সি্নগ্ধ প্রস্রবণ;
তৃষিত তাপিত যেন মোর কাছে আসি'
পিপাসার করে নিবারণ।
নির্মম বীরের করে করিও না মোরে
প্রিয়তম, তীক্ষ্ন তরবারি;
করো মোরে ক্ষুদ্র লাঠি, দুর্বলেরা যেন
চলাফেরা করে হাতে ধরি'।
বিলাসী সম্পদশালী করিও না মোরে
অনুক্ষণ মত্ত অহঙ্কারে
করো দীন, ত্যাগী দাস, সবারই যেন
সেবা আমি পারি করিবারে।
সাংবাদিক প্রফুলস্ন কুমার ভক্তকে হারিয়েছি গত ৪ অক্টোবর। তিনি আমার সহকমর্ী ছিলেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৮৪ সালে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সম্পর্কে তাঁর কয়েকটি রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে একাধিক নিবন্ধ লিখেছিলাম সম্পাদকীয় স্তম্ভে। কিছু কাজ হয়েছিল তাতে। অন্তত আসন্ন বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
রাজনীতিবিদ আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার বিদায় অত্যন্ত দুঃখপূর্ণ হয়েছে আমাদের জন্য। একদিকে গুরুতর অসুস্থতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক জীবনের ওলট-পালট বিপর্যয়ের মধ্যে এক ট্র্যাজিক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে তাঁকে।
ষাটের দশকের উত্তাল ছাত্র-রাজনীতির সূত্রে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, মান্নান ভুঁইয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। পরিচয়ের সূত্র ছিলেন অবশ্য কবি-রাজনীতিক বুলবুল খান মাহবুব। তাঁরা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গণআন্দোলনের দিনগুলোতে তিনিও এক অগ্রজ বন্ধু হয়ে ওঠেন আমার। পরিচয়ের সূত্র ছিল অবশ্য আরো একটি। আমার পিতামহ দেলদুয়ারের পীরসাহেব শাহ সুফি মোহাম্মদ আবদুর রকিব জীবনের শেষ কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন নরসিংদী, শিবপুর, ভবানীপুর অঞ্চলে। ওখানে অনেক মুরিদ ছিলেন তাঁর, এখনও আছেন অনেকে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মান্নান ভুঁইয়ার পরিবারের সদস্য ও অন্য আত্মীয়-স্বজনও। তিনি আদর্শবাদী রাজনীতিক ছিলেন কিন্তু নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন আদর্শহীন রাজনীতির মধ্যে। তা-ই ছিল তার জন্য বেশি দুঃখপূর্ণ। দু'-একবার ডেকেছিলেন, দু'-একবার নিজে থেকেও গেছি তাঁর ওখানে। তখন তাঁর আশপাশে দেখেছি একশ্রেণীর ট্যান্ডলদের ভিড়। ওই ভিড় ভাল লাগেনি আমার। তবে আদর্শবাদী রাজনীতিবিদদের মধ্যে যাঁরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল থাকতে পেরেছেন তাঁদের একজন দেওয়ান ফরিদ গাজীকে আমরা হারিয়েছি গত বছর। মনে পড়ে ২০০২ সালে এক অনুষ্ঠানের সূত্রে সিলেটে গিয়ে একদিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে পেরেছিলাম তাঁর সানি্নধ্যে। তাঁর লামাবাজারের সাধারণ, ছিমছাম কিন্তু ঐতিহ্যমণ্ডিত বাড়িতে অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। কথায় কথায় জেনেছিলাম, শিখেছিলাম কত কিছু। সেসব কথায় রাজনৈতিক বিষয়াদিই ছিল মুখ্য। তবে আমি টাঙ্গাইলের জেনে তিনি বিশেষভাবে কথা বলেন আবদুল মান্নান ও কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে। মুক্তিযুদ্ধে দু'জনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান যে এখনও সেভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না তা তিনি বলেন দুঃখের সঙ্গে। নিজের সম্পর্কে বলেন, আমি সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের মধ্যেই মিশে থাকতে চাই। আমি আলাদা কোনও পরিচয় নিয়ে আলাদা হয়ে থাকতে চাই না। পরে একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, আমার জীবনের প্রার্থনা এটাই। সেই থেকে ওই কবিতাটিও প্রার্থনা হয়ে আছে আমার।
আসুন, আজ এক বর্ষকে বিদায় জানিয়ে আরেক বর্ষকে স্বাগত জানানোর মুহূর্তে আমরা সকলে মিলে পাঠ করি শেখ ফজলুল করিম-এর "প্রার্থনা" নামের সেই কবিতাটি:
প্রভু, করো মোরে শস্যশ্যামল সমতল মাঠ
করিও না তুঙ্গশির গিরি;
ক্ষুধিত আমাতে যেন পায় গো আহার,
ক্ষুণ মনে নাহি যায় ফিরি'।
লবণ-সমুদ্র তুমি করিও না মোরে
করো দেব, সি্নগ্ধ প্রস্রবণ;
তৃষিত তাপিত যেন মোর কাছে আসি'
পিপাসার করে নিবারণ।
নির্মম বীরের করে করিও না মোরে
প্রিয়তম, তীক্ষ্ন তরবারি;
করো মোরে ক্ষুদ্র লাঠি, দুর্বলেরা যেন
চলাফেরা করে হাতে ধরি'।
বিলাসী সম্পদশালী করিও না মোরে
অনুক্ষণ মত্ত অহঙ্কারে
করো দীন, ত্যাগী দাস, সবারই যেন
সেবা আমি পারি করিবারে।
Post a Comment