নারীর প্রতি সহিংসতা- ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ by উম্মে মুসলিমা

নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ হলো নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গ বা অধস্তন হিসেবে বিবেচনা। ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’-এর সংজ্ঞার মধ্যে নারীও অন্তর্ভুক্ত। যোগ্যদেরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে।
বনের বড় ও শক্তিশালী পশুরা ছোট ও দুর্বল পশুদের ভক্ষণ করে বেঁচে থাকে। কীটপতঙ্গ, পক্ষী ও মৎস্যকুলেও একই চিত্র। মনুষ্যসমাজই বা এর বাইরে থাকে কেন?

যে সমাজ নির্ধারণ করে পুরুষই প্রধান, বাহুবলে বীর, বুদ্ধিতে প্রখর, শারীরিক উচ্চতা ও ওজনে অধিক, অকুতোভয়—তারা ভাবতেই পারে, তাদের চেয়ে দুর্বলদের দমন তাদের কর্তব্য। কাব্য করে বলা হয়ে থাকে, নারী হরিণবিশেষ, ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। এখনো পুরুষসমাজ নারীকে মাংসপিণ্ড হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। অথচ নারী তাঁর আপন মহিমায় দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছেন। শত প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে নারী স্বাক্ষর রাখছেন অনেক চ্যালেঞ্জিং পেশায়। এ যুগ খনা বা জোয়ান অব আর্কের যুগ না হলেও একবিংশ শতাব্দীতে সাহসী, বুদ্ধিমান নারী অনেক নিগ্রহ, অনেক সমালোচনার শিকার। হাতে গোনা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ কটা বাদে নারীর প্রতি মনোভাব অন্য সব দেশে কমবেশি একই রকম।

আমাদের দেশে যখন কোনো কোনো নারী সাংবাদিক তাবড় তাবড় মহাজনকে বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নবাণে ঘায়েল করেন বা কোনো তথ্য উদ্ঘাটনে পুরুষ সহকর্মীদের সমান বা তাঁদের চেয়ে ভালো করেন, তখন তাঁদের সম্পর্কে বলা হয়, ‘আরে, ওর ভেতর কোনো মেয়েসুলভ আচরণ দেখেছ?’ কিংবা ‘ভাবখানা সবজান্তা, জানে তো ঘণ্টা!’ আরও অনেক বাজে কথা রটিয়ে দেওয়া হয়। এসব মাৎসর্য ছাড়া আর কিছুই নয়।

নারী কেন ঘরে বসে সেলাই-ফোঁড়াই করেন না, কেন কেবল সন্তান মানুষ করেন না, নারীর প্রতি নির্যাতনের জন্য নারী নিজেই দায়ী। অনেকে বলবেন, নারীর ওপর নারীও তো সহিংস হয়ে ওঠেন। তাহলে আর কেবল পুরুষতান্ত্রিকতার দোষ কেন? পুরুষতন্ত্র অর্থে এখানে ক্ষমতাবানদের কথাই বলা হয়; তিনি নারীও হতে পারেন। নারীর প্রতি সহিংসতারও অনেক রূপ। শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, নারীকে মানসিক নির্যাতনেও প্রাণ দিতে হয়।

দুর্বলদের উপহাস করে সবলেরা একধরনের অশ্লীল আনন্দ উপভোগ করে। নতুন জামাইকে নিয়ে শালা-শালিরা যেসব কাণ্ড করে, সেখানে মজাটাই মুখ্য। কিন্তু নতুন বউকে সহ্য করতে হয় বিভিন্নজনের খোঁটা। কারণ, বউটা একে একা, তার ওপর অসহায়। তা ছাড়া শ্বশুরবাড়ির ছোট-বড় সবাই তাঁর অভিভাবক।

গ্রামগঞ্জে একটা কথা প্রচলিত, ‘গরিবের সুন্দরী বউ’। গরিবের সুন্দরী বউ রাখারও উপায় নেই। সুন্দর পালনের অধিকার কেবল ধনীদের। সিন্ডারেলা দুঃখী, দরিদ্র, গুণী মেয়ে, কিন্তু সুন্দরী না হলে যতই জুতোর মাপ সঠিক হোক, রাজপুত্র হতাশ হয়েই প্রাসাদে ফিরে আসত।

বড় বড় মাছ ছোট মাছদের খেয়ে ফেলে। মনুষ্যসমাজেও এ রকম নৈরাজ্যকর কালের উদ্ভব হলে তাকে বলে মাৎস্যন্যায়। নারীর জীবনে চিরকালই মাৎস্যন্যায়। পুরুষসমাজ নারীকে ভাবতে শিখিয়েছে যে নারী যত কোমল, তিনি তত গ্রহণীয়। এর মূল কথা হলো, নারী কোমল ও দুর্বল হলে তাঁকে নিপীড়ন করা সহজ হয়। তাই মেয়েরা যখন পেশিবহুল খেলা বা প্রতিরক্ষামূলক পেশায় নিয়োজিত হন, তাঁদের বিয়ে দেওয়া বা হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই মেয়েদের পেশা নির্ধারণ করে দেন মা-বাবা, যাতে তাঁদের মেয়েরা সারা জীবন মার খেতে পারেন।

তবে শিক্ষিত মানুষজনের মধ্যে নারী নির্যাতনের প্রবণতা একটু কম। এ শিক্ষিতেরও সংজ্ঞা আছে। যাঁরা স্বশিক্ষিত নন, তাঁরা যত উচ্চশিক্ষিতই হোন না কেন, নিজেদের পরিবর্তন করতে পারেন না। প্রকৃতির কাছে মানুষ চিরদিনের শিক্ষার্থী।

একসময় আমাদের প্রপিতামহী-প্রমাতামহীরা ছিলেন প্রায় অসূর্যম্পশ্যা। এ রকম রূপকথাও প্রচলিত: একজন কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র বাবার কুটিরে আশ্রয় নিলেন একজন রাজার ছেলে। রাজার ছেলে গৃহস্বামীর আতিথ্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে যা ইচ্ছে চাওয়ার অনুমতি দিলেন। গৃহস্বামী বললেন, তাঁর ঘরে একজন অন্ধ, কালা, বোবা ও খঞ্জ বিবাহযোগ্য মেয়ে রয়েছেন। যদি অনুগ্রহ করে রাজপুত্র তাঁকে বিয়ে করেন, তাহলেই তিনি কৃতার্থ হবেন।

রাজপুত্র বড় মনের মানুষ, তাই দ্বিধা সত্ত্বেও রাজি হলেন। বিয়ে হয়ে গেলে রাজপুত্র দেখলেন, এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে তাঁর বধূ। তিনি অন্ধ-কালা-বোবা-খঞ্জ কিছুই নন। শ্বশুরমশাইকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, তাঁর মেয়ে কোনো পরপুরুষকে চাক্ষুষ করেননি, তাই তিনি অন্ধ, কোনো পরপুরুষের কথা শোনেননি, তাই তিনি কালা, কোনো পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলেননি, তাই তিনি বোবা আর বাড়ি ছাড়া কোথাও যাননি তাই তিনি খঞ্জ।

রাজপুত্র ধন্য হয়ে গেলেন এমন সর্বগুণসম্পন্না স্ত্রী পেয়ে। তো, সেসব দিন নেই। সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছু বদলাচ্ছে। পরিবর্তনকে অনেকে দ্রুত গ্রহণ করছেন, অনেকে একটু দেরিতে, অনেকে করছেনই না। যাঁরা পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে পারছেন না, তাঁদের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে যত অনাচার।

বলা হয়, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। নারী-পুরুষ উভয়েই মানুষ। নারীর শারীরিক পরিবর্তন, অভ্যন্তরীণ অবস্থান্তর—এসবই প্রাকৃতিক। এটি কোনো অধস্তনতার পরিচয় বহন করে না বা এতে তাঁকে দুর্বল ভাবার কারণ নেই। পুরুষ পেশিবহুল। ভারী কাজ করার ক্ষমতা রাখে। নারীর ক্ষমতা অন্তরীণ। সন্তান ধারণ, জন্মদান ও লালনের ক্ষমতাকে যাঁরা বড় করে দেখেন, তাঁরা নারীর বাহ্যিক গড়নকে নিজেদের শরীরের সঙ্গে তুলনায় আনা বোকামি ভাবেন। তাহলে যাঁরা সন্তান জন্ম দেন না বা পারেন না, তাঁরা কী ক্ষমতাহীন? তাহলে খনা বা জোয়ান অব আর্কের প্রজ্ঞাকে কী নামে অভিহিত করি? পাহাড়ি বা আদিবাসী সমাজে নারীরাই বেশি কর্মঠ। তার পরও কেবল নারী হওয়ার অযোগ্যতাতেই তাঁরা দমিত।

এককালে কায়িক পরিশ্রম দিয়ে মানুষের শক্তি-সামর্থ্য বিচার করা হতো। কিন্তু এখন অসির চেয়ে মসির মতো পেশির চেয়ে মস্তিষ্কের শক্তি বেশি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে দিনকে দিন। নারী-পুরুষনির্বিশেষে যোগ্যতা প্রমাণের সমান সুযোগ খুঁজে নিতে হবে। এখন সময় বুদ্ধিবৃত্তিতে যে বেশি যোগ্য, সে-ই ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’।

উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger