পালাবদল- সংঘাতের কেন্দ্রে এশিয়ার নতুন নেতারা by পঙ্কজ মিশ্র

এশিয়ার শহরমুখী অভিবাসন ঘটাচ্ছে এক ‘ফাটানো পালাবদল’। কীভাবে এশিয়ায় ধনকুবের হওয়া যায়, তা নিয়ে পাকিস্তানি ঔপন্যাসিক মোহসিন হামিদ বই লিখেছেন।
সেখানে তিনি বলেছেন, ‘সহায়ক, সীমাবদ্ধ, স্থায়ী সম্পর্কের বন্ধন আলগা হয়ে জায়গা করে দিচ্ছে, জাগিয়ে তুলছে নিরাপত্তাহীনতা, উদ্বেগ, উৎপাদনশীলতা ও সম্ভাবনাকে।’

এশিয়াজুড়েই এই পালাবদলের রাজনৈতিক সম্ভাবনা ব্যাপক। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সময় এর প্রথম দেখা মিলেছিল। সেখানে রেজা শাহ পাহলভির আমলে মহাসমারোহে দ্বিগুণ গতিতে নগরায়ণ করতে গিয়ে কৃষকেরা উচ্ছেদ হন। এই বিক্ষুব্ধ শ্রেণীটিকেই নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসে ইসলামি বিপ্লবীরা এবং তাঁরাই হন এদের প্রধান অনুগত ভিত্তি।
হাল আমলে জনসংখ্যার গঠনের রদবদলের সুফল নিয়ে ক্ষমতাসীন হয় তুরস্কের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি)। এর নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান প্রায় এক দশক অপ্রতিহত অবস্থানে দেশ শাসন করেন। থাইল্যান্ডের টেলিকম বিলিয়নিয়ার থাকসিন সিনাওয়াত্রার উত্থানের গল্পটাও এ রকমই। তিনি এর আগে উপেক্ষিত দুটি গোষ্ঠী: ব্যাংককের শহুরে গরিব আর উত্তর থাইল্যান্ডের বঞ্চিত গ্রামবাসীকে একতালে আলোড়িত করেন।
শহর এলাকা থেকে নতুন ধরনের মোহজাগানো রাজনীতিকের উত্থান ঘটেছে ইন্দোনেশিয়ায়ও। তিনি হলেন জাকার্তার গভর্নর জোকো উইদোদো। ভারতের নয়াদিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উত্থানের চালিকাশক্তিও এই শহুরে নিম্নবর্গ। নতুন নেতাদের ব্যতিক্রমী অতীত পেশাদার রাজনীতিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ভোটারদের কাছে টেনেছে। জনপ্রিয়তার সুবাদে তাঁরাও পুরোনো পৃষ্ঠপোষকতার নেটওয়ার্ক এবং জাত, ধর্ম ও আঞ্চলিকতাকে তেল-তোয়াজ করা এড়িয়ে যেতে পেরেছেন। এশিয়াজুড়ে সাবেকি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক এলিটদের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে; কখনো কখনো তাঁরা উৎখাতও হয়ে যাচ্ছেন। একেবারে নতুন সামাজিক যোগাযোগজাল, এনজিও-ধরনের তৎপরতা এবং মিডিয়াবান্ধব ঘষামাজা ইমেজ ও প্রতীক—যেমন কেজরিওয়ালের বেলায় গান্ধী টুপি—রাজনীতির বিকল্প পথ গড়ে নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ, ক্ষমতার দালাল ও ব্যবসায়ীদের গড়ে তোলা ভারসাম্য ভেঙে দিচ্ছে শহুরে শ্রমিক এবং চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
এশিয়াজুড়ে ঘটে চলা এই নতুন ঘটনা যতই ‘অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র’ অথবা ‘আমজনতা’ আবিষ্কারে উল্লসিত হোক না কেন, এ ফাটানো পরিবর্তনের অন্য দিকটির দিকে অনেকেরই নজর নেই। এটা জন্ম দিচ্ছে সংঘাতেরও বিস্ফোরণ। সর্বক্ষেত্রে অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে আসা এই সংঘাতের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেমন বলা যায়, আমজনতার বিদ্রোহ এলিট মহলের তরফে পাল্টা-বিদ্রোহ উসকে দিচ্ছে। সাবেকি এলিটরা নিজের অবস্থান আপসে আপ ছেড়ে দেবে না। রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বাইরে থেকে থাই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্তের ক্রোধ দেশটাকে অবশ এবং অর্থনীতিকে করে দিচ্ছে অবশ। যে এরদোয়ান একসময় তুরস্কের ওপর প্রায় ওসমানিয়া সাম্রাজ্যকালীন অধিরাজ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁকে এখন বিরোধী জোটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই বিরোধী জোট গঠিত হয়েছে মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ী এবং সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক এলিটদের নিয়ে। ঠিক এ ধরনেরই একটা জোট থাকসিনকে নির্বাসিত করেছিল এবং এখন তাঁর বোনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
দিল্লিতে কেজরিওয়ালের অপ্রত্যাশিত অর্জন সুনিশ্চিত হয়েছিল মধ্যবিত্ত এবং শহুরে গরিব ভোটারদের ঐক্যের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এ জোট কেজরিওয়ালের দিল্লির দপ্তরকে বেশি দিন শান্তিতে থাকতে দেবে বলে মনে হয় না। কারণ, মধ্যবিত্তরা চায় স্বচ্ছ ও দক্ষ সরকারি সেবা, অন্যদিকে সুবিধাবঞ্চিতরা চায় মৌলিক সামাজিক অধিকারের বাস্তবায়ন। দেখা যাচ্ছে, সংখ্যায় বৃহত্তর গরিব শ্রেণীই কেজরিওয়ালের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলোর লক্ষ্য।
ব্যাংককে থাকসিনের বোনের বিরুদ্ধে চলমান প্রতিবাদ দেখায় যে, দুই ধরনের গণতন্ত্রের মধ্যকার সংঘাতে একটি দেশ কেমন অচল হয়ে যেতে পারে। এই গণতন্ত্রগুলোর একটি গঠিত হয়েছে আগেকার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে, যারা চায় যে রাজনীতিবিদেরা তাদের ওপর ভর্তুকি, জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধার ঝরনা ঝরান। অন্য পক্ষটি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ঘিরে পাক খাচ্ছে। এরা জনমনকে খুশি করার কাজকারবার ঘৃণা করে, উঠে আসা সামাজিক শ্রেণীগুলোর রাজনৈতিক ভূমিকাকে ভয় পায়। এ ভয় থেকেই তাদের দৃষ্টিতে অদক্ষ সরকারের পতনের জন্য তারা মরিয়া।
ভারতে সাবেকি রাজনৈতিক আনুগত্য জাত-বর্ণের সংহতি এবং অন্যান্য ধরনের পরিচয় ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি দিয়ে কাটাকুটি হয়ে যাচ্ছে। দলিত, সাম্প্রদায়িক, আঞ্চলিক ও শ্রেণীসংঘাত যখন পরস্পরকে দুর্বল করায় ব্যস্ত, তখন দিল্লির মতো জায়গায় দুর্নীতি ও সুশাসনের মতো স্থানীয় ইস্যু সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে। আর তাই কেজরিওয়ালকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জাত-সম্প্রদায়ের সনাতন ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর কাছে ধরনা দিতে হয়নি। তিনি সরাসরি সবার জন্য নাগরিক অধিকারের দাবি তুলেছেন। তবে অচিরেই তাঁর বামমনা সহকর্মী, মধ্যবিত্ত থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবক কর্মী এবং নিচুতলার ভোটারদের মধ্যে বেসুরো মতাদর্শিক মতভেদ তৈরি হতে পারে।
গত সপ্তাহে কেজরিওয়াল আগের সরকারের আমলের মাল্টিব্র্যান্ড সুপারশপে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ বাতিল করেছেন। এটা খুদে দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের খুশি করলেও আরও সচ্ছল ভোটারদের মনঃপূত হবে না। যেসব করপোরেশন সাততাড়াতাড়ি তাঁর রাজনৈতিক গতিধারার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে, এটা তাদেরও নাখোশ করবে। যেসব কায়েমি রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষক আম আদমির রাজনৈতিক উত্থানে বেকায়দায় পড়ে গেছে, তারাও চাল দেওয়া শুরু করেছে। ইতিমধ্যে তারা জম্মু ও কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির মতো বিতর্কিত ইস্যুতে কেজরিওয়ালকে কথা বলার জন্য চাপ দিচ্ছে। নির্বাচিত রাজনীতিবিদেরা যতটা হানিমুন-সময় পান, সেটাও কেজরিওয়াল পাচ্ছেন না। জনতুষ্টিবাদী সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে এঁদের আক্রমণের শিকার কেজরিওয়াল হরহামেশাই হচ্ছেন।
কার্যকর বামপন্থী দল না থাকার সুবিধা কেজরিওয়াল সাময়িকভাবে পাচ্ছেন। ভারতের কোনো বামপন্থী দলই সর্বভারতীয় স্তরে সামাজিক ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক সংঘাতের ফায়দা নিতে সক্ষম নয়। এমনকি মৌলিক পরিবর্তনকামী রাজনীতিবিদেরাও নিজেদের সব আদর্শের প্রতি নিরপেক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করছেন। শাসকের বিরুদ্ধে শাসিতদের চালনা করে কেজরিওয়াল খুব আকর্ষণীয় ও সহজ রাজনৈতিক কর্মসূচি হাজির করেছেন।
অস্পষ্টতা কিংবা সবাইকে খুশি করার চেষ্টা রাজনীতির এক অনস্বীকার্য সম্পদ। কিন্তু সারা দেশের আগে অন্তত দিল্লিতে হলেও কেজরিওয়ালকে বিভক্ত রাজনৈতিক দৃশ্যপটের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতেই হবে; যেখানে গ্রামীণ গরিব, শহরে অভিবাসিত পল্লির মানুষ এবং মধ্যবিত্তরা পরস্পরের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি উত্তেজনার মধ্যে বাস করছে। আর এ চাপ ঘনীভূত হচ্ছে শ্রেণী ও বর্ণগুলোর মধ্যে বাড়তে থাকা অনিবার্য ও ক্রমবর্ধমান সংঘাতের পটভূমিতে।
গালফ নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
পঙ্কজ মিশ্র: ভারতীয় লেখক ও ঔপন্যাসিক।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger