এ নিপীড়ন সার্বক্ষণিক ও বহুমাত্রিক by জাকারিয়া পলাশ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্বাধীন সেন বলেছেন, সদ্য নির্বাচন কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো আমাদের নজরে আসছে। কিন্তু নিপীড়ন চলছে সার্বক্ষণিক।
নির্বাচন নিপীড়নকে আরও প্রত্যক্ষ করে তুলেছে, নিপীড়নের সহিংস রূপের প্রকট প্রকাশ ঘটিয়েছে মাত্র। প্রতিদিনের জীবনযাপনে আমরা সাম্প্রদায়িক বিভেদকে পরিপুষ্ট করে চলেছি। একই সঙ্গে বলে চলেছি, আমরা অসাম্প্রদায়িক।

মানবজমিন অনলাইনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা যেমন দরকার, তেমনই দরকার বিভেদের অনুশীলনগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার রাস্তা খোঁজা। সাংবিধানিক, আইনগত, চর্চাগত বৈষম্যগুলোকে দূর করার তৎপরতা জোরেশোরে শুরু করা দরকার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের দাপুটে বয়ান আর জাতীয়তাবাদী আখ্যানে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও সহিংসতার চেতনাগত প্রেক্ষাপটকে স্বীকার করা হয় না। একে কেবল ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এটাই সাম্প্রদায়িকতা জারি থাকার অন্যতম প্রধান কারণ। অন্যদিকে, সাংবিধানিক, আইনগত ও গণতান্ত্রিক বিধিবিধানের পক্ষপাতদুষ্ট প্রয়োগের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা পৌনঃপুনিকভাবে ঘটে চলেছে।
সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসের এই গবেষক আরও বলেছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের ঐতিহ্য নতুন নয়। আমার মতে, সাম্প্রদায়িকতা প্রধানত দুই রকমের, এক. ইতিহাস ও চৈতন্যগত; দুই. বিভিন্নভাবে নির্মিত ও সৃষ্ট। উপনিবেশপূর্ব ও উত্তর-ঔপনিবেশিক ইতিহাসে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত আর এক সম্প্রদায়ের ওপরে আরেক সম্প্রদায়ের সহিংসতার ঘটনাবলি বিভিন্ন ঐতিহাসিক শর্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ’-এই কথাটির পেছনেও ঐতিহাসিক অসত্যতা আছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশে অ-মুসলিম ও অ-বাঙালিদের ওপরে নানামুখী নিপীড়নের, নির্যাতনের ও রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের অনেক ঘটনা আছে। ঐতিহাসিক ও চৈতন্যগতভাবে জন্ম নেয়া সাম্প্রদায়িক বিভেদকে বিলোপ করার চেষ্টা করা হয়নি। বরং তাকে আড়াল করে আমরা ‘সংখ্যাগুরুর’ দাপটকে বৈধতা দিয়ে চলেছি।
এই সহিংসতার পেছনে দায়ী কারা এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন, পুনঃপুনঃ সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে শুধুমাত্র ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’কে দায়ী করলে সামগ্রিক চিত্র স্পষ্ট হয় না। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলোও এখানে মুখ্য। অ-মুসলিম ও অ-বাঙালিদের জমি, বসতভিটা ও ব্যবসা দখলের আইনি ও বেআইনি তৎপরতাগুলো ব্যাপক ও স্বাভাবিকভাবে চলে আসছে। এর পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতের মতো বহুমাত্রিক বিষয় জড়িত ছিল।
বারবার হামলা, নির্যাতনের পরও দায়ীরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে কোন রাজনৈতিক স্বার্থ আছে বলে মনে করেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাংবিধানিকভাবেই তো বাংলাদেশে অ-মুসলিম ও অ-বাঙালিরা প্রথম শ্রেণীর নাগরিক নন। বিশেষ পরিস্থিতিতে ‘সংখ্যালঘুদের’ জন্য আলাদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়ার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে। অর্পিত সম্পত্তির মত নিবর্তনমূলক আইন এখনও বলবৎ রয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কমিয়ে আনার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে আলাদা আইন ও বিচারিক প্রক্রিয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যে, যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময়ে সহিংসতা ও হামলার সঙ্গে জড়িত থাকে তারা রাষ্ট্র ও ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পায়। বিচার না করাও এক ধরনের পৃষ্ঠপোষকতারই প্রমাণ। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোন সাম্প্রদায়িক হামলাকারীরই বিচারের ও শাস্তির নজির নেই। শুধু রাজনৈতিকই নয়, দলীয় স্বার্থ, আত্মীয়তার স্বার্থ, অর্থনৈতিক স্বার্থ, গোষ্ঠীগত স্বার্থ- এমন নানামুখী ও বিচিত্র স্বার্থ এখানে জড়িত থাকে। আর এ সাম্প্রদায়িকতা সর্বদলীয়। বিচারহীনতা এর অন্যতম কারণ। তবে সেটা একমাত্র কারণ না। আমাদের যাপিত জীবনে অসাম্প্রদায়িকতা যেমন সত্য, সাম্প্রদায়িকতাও তেমনই বাস্তব। একটি গভীর বহুত্ববাদী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু করা জরুরি। একথা আজ প্রমাণিত যে, এই লড়াই লড়তে গেলে বিদ্যমান ইতিহাস চৈতন্য, জাতীয়তাবাদী স্বৈরাচার, আর বহু ব্যবহারে জীর্ণ ভাষা ও অভিব্যক্তির জায়গায় ভিন্ন ভাষা-অভিব্যক্তি-চর্চার সন্ধান আমাদের করতে হবে। সেটা দীর্ঘমেয়াদি কাজ। আপাতত, দায়িদের বিচারের আওতায় আনা আর সহিংসতার শিকার মানুষগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকতার বোধ ফিরিয়ে আনা দরকার। সেই উদ্যোগ রাষ্ট্র, সরকার, প্রচারমাধ্যম এবং সংখ্যাগুরুসহ ক্ষমতাশালী পক্ষগুলোকেই নিতে হবে।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger