সরকার আদিবাসীদের অধিকারের কথা স্বীকার করে নাঃ সন্তু লারমা

দিবাসী ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক দুটি অনুষ্ঠানে গতকাল বুধবার বক্তারা ‘আদিবাসী’ কথাটির বিষয়ে সরকারের সাম্প্রতিক অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এত দিন সমস্যা না থাকলেও এখন এ নিয়ে নেতিবাচক কথা বলায় প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। কয়েকজন বক্তা আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য আন্দোলনের পক্ষেও মত দেন। ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভূমি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমি কমিশনের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে সভাপতি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা। তিনি এতে অভিযোগ করে বলেন, এই সরকার গণতন্ত্র আর সুশাসনের কথা বললেও তারা আদিবাসীদের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা স্বীকার করে না। সন্তু লারমা পার্বত্য চুক্তির সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনকে কার্যকর করারও দাবি জানিয়েছেন।
আগারগাঁওয়ের এলজিইডি ভবনে এই সেমিনারের আয়োজন করে অ্যাসোসিয়েশন অব ল্যান্ড রিফর্মস ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। বাঙালি-আদিবাসী বিতর্কের প্রসঙ্গ তুলে আদিবাসী ফোরামের সভাপতি সন্তু লারমা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, আমরা নাকি বিদেশি আর বাঙালিরা আদিবাসী। সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে, আদিবাসীরাও বাঙালি। আমি যদি বলি, তিনি (শেখ হাসিনা) জাতি হিসেবে চাকমা, তাতে তিনি কি রাজি হবেন? আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলাম কায়েম করার জন্যই এসব করা হচ্ছে।’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘জিয়ার আমলে যে বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল, এই সরকার সেই বৃক্ষকে এখনো কেন জিইয়ে রাখছে! ...কাগুজে মালিকানা দিয়ে আদিবাসীদের জমি আত্মসাৎ করা হচ্ছে। তামাক চাষের জন্য বহুজাতিক কোম্পানির কাছে জমি লিজ দেওয়া হচ্ছে। এতে জটিলতা বাড়ছে। দ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না করলে এই সমস্যা আরও প্রকট হবে।’
‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন মানবাধিকার নেত্রী খুশী কবির। তিনি এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তিতে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও তা ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা তো তাদের ভোট দিয়েছি ইশতেহার দেখে। এখন এমন কী হলো যে “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না? আসলে প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যই সরকার এখন আদিবাসী বলতে নারাজ।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, ‘আদিবাসীদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আর আমলারা পাহাড় কিনে নিচ্ছেন। ছেলেমেয়ের বিয়েতে তাঁরা পাহাড় উপহার দেন। এসব বন্ধ করতে হবে।’
সামাজিক বনায়ন নীতিমালার মাধ্যমে আদিবাসীদের ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তথ্য কমিশনের সদস্য সাদেকা হালিম। তিনি আরও বলেন, ভূমি কমিশনের কাজ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা, ভূমি জরিপ নয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সমালোচনা করে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘বাংলাদেশে বহু জাতির বাস। অথচ আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি বলে পরিচিত হবে। এতে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকাশ পেয়েছে।’
সন্তু লারমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা।
‘সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ’: ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে নির্বাচিত আদিবাসীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া উপায় নেই।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই শতাধিক আদিবাসী নির্বাচিত হয়েছেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদ তাঁদের এই সংবর্ধনা দেয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।
শিশু একাডেমী প্রাঙ্গণে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সাংসদ হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘সরকার আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়নি। উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসহ বিভিন্ন নাম দিয়েছে। সরকার যে নামেই ডাকুক, আমি আদিবাসীই বলব। আপনারাও নিজেরা নিজেদের আদিবাসীই বলুন। মূর্খদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। লড়াই করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হোন।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘আদিবাসীদের সাংবিধানিক প্রশ্নে সরকার কিছু কিছু প্রশ্নবিদ্ধ পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেন এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা আমরা বুঝতে চাই। কেননা, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের বন্ধু। প্রধানমন্ত্রীকে যারা ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, কমিশন তাদের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসী শব্দ আছে। আর এখন আদিবাসী মানুষকে বাঙালি বানিয়ে জাতিসত্তাকে অস্বীকার করছে সরকার। এতে করে লড়াইয়ের বাইরে আর পথ দেখি না।’
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি অনিল মারান্ডি বলেন, ‘সরকার আমাকে কী নামে ডাকবে, তা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। আমাকে বাঙালি বানিয়ে আমার সাঁওতাল পরিচয় মুছে দিতে চাচ্ছে। আমি নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই।’
অনুষ্ঠানে সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবে ১৫১ জন আদিবাসী জনপ্রতিনিধিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পার্বতীপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের সদস্য বিচিত্রা তিরকি বলেন, ‘আমরা এত দিন কথা বলার সুযোগ পাইনি। পরিষদের বিভিন্ন ভাতা ও কর্মসূচি থেকে আমরা বাদ পড়তাম। এবার কথা বলতে পারব।’ অন্য জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে বিচিত্রা তিরকি বলেন, ‘কার্ড বিতরণে আপনারা টাকা নেবেন না। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের সমস্যার সমাধান করবেন। নেটওয়ার্কের যুগ, একজন আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।’
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা জনপ্রতিনিধি নৃপেন্দ্রনাথ মাহাতো, সুনীল কান্তি দেওয়ান, অমলাচিং মারমা প্রমুখ বক্তব্য দেন। জনপ্রতিনিধিরা বেহাত হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধার, সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায় ও আদিবাসী নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার করেন।
দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের দেশীয় পরিচালক বদিউল আলম মজুমদার, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সরেন ও পরিষদের সদস্য বিমলচন্দ্র রাজোয়ারও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger