নূহার জন্য শোকগাথা by ওমর ফারুক

'মা, তুমি কক্সবাজার চলে এসেছ। একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখো তোমার প্রিয় কক্সবাজার। আমার কথা যেন বুঝতে পারছিল ও। গুলিতে তার ডান চোখটা বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার চিৎকার শুনে সে বাঁ চোখ দিয়ে তাকাল। তখন যেন সারা দুনিয়াকে দেখে নিয়েছিল ওই একটি চোখেই, এক তাকানোতেই। শেষ পর্যন্ত চোখ খোলা রেখেই আমাদের সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় আমার প্রিয় সন্তান। আমার হৃদয়ের টুকরো।' বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কম্পানির কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক তরুণ।
মেয়ের বায়না ছিল কক্সবাজার বেড়াতে যাবে। গত ৩০ জুন কক্সবাজারের চকরিয়া এলাকা দিয়ে মাইক্রোবাসে যাচ্ছিলেন তাঁরা। হঠাৎ ডাকাতরা গুলি চালায়। একটি গুলি তরুণের বাঁহাত ভেদ করে তাঁর কোলে ঘুমিয়ে থাকা নুহার মাথায় আঘাত করে।
'নূহা প্রায় দিনই আমার বুকের ওপর ঘুমাত। মেয়ে সামান্য ব্যথা পেলেও সে ব্যথা যেন লাগত আমার গায়ে। আর সেই সন্তানের মৃত্যু হলো আমার কোলেই।' কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেন জহিরুল হক তরুণ। 'ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করে আমার কোলে ঘুমিয়ে গিয়েছিল ও। কিন্তু আর জেগে দেখতে পেল না পৃথিবীর আলো। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি বাবার কোলে শিশুরা নিরাপদ। কিন্তু আমার কোলে থাকা অবস্থায় আমার মেয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। আমি কেন পারলাম না আমার প্রিয় সন্তানকে বাঁচাতে?' তরুণের কণ্ঠে হাহাকার।
নূহার মা মুনমুন ওরফে মুনও শোকে পাথর। তিনি কী বলবেন, কোনো ভাষাই যেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শুধু বললেন, 'কোনো দিন গুলির শব্দ শুনিনি। সে দিন শুনলাম। আর সেই গুলিই কেড়ে নিল আমার সন্তানকে। এই কষ্ট কিভাবে সহ্য করব আমি।'
যেভাবে ঘটনা : তরুণ কালের কণ্ঠকে জানান, ৩০ জুন একটি মাইক্রোবাস ভাড়া নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি, তাঁর স্ত্রী মুনমুন, মেয়ে নূহা, বন্ধু রিপন, সহকর্মী জাফর ও রিপনের ছোট ভাই সাজ্জাদ ও আজাদ। বিকেল ৩টার দিকে তাঁরা ঢাকা থেকে রওনা দেন। ওই দিন ছিল প্রচণ্ড বৃষ্টি। রাস্তার অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে গাড়ি খুব দ্রুত যেতেও পারছিল না। পথে মিরসরাইসহ কয়েকটি স্থানে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যেতে আরো দেরি হয়। রাত হয়ে যাওয়ায় ও বৃষ্টির কারণে রাস্তার পাশের হোটেলগুলোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে সবাই ক্ষুধার্তও ছিলেন সে দিন। চকরিয়ায় গিয়ে ভালো হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করবেন_এ চিন্তায় চালক জাকিরকে দ্রুত চালাতেও তাড়া দিচ্ছিলেন তরুণ। চট্টগ্রাম পেরোতে পেরোতে রাত দেড়টা বেজে যায়। পটিয়ায় গিয়ে মাইক্রোবাসে গ্যাস নেওয়ার সময় নূহা পেছনে তার মায়ের কোল থেকে গিয়ে বাবার কোলে ওঠে। তরুণ তাকে নিয়ে চালকের পাশের সিটে বসেন। কিছু দূর গিয়ে দেখতে পান একটি ট্রাক অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। যে কারণে সেখানে অনেক গাড়ি সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অনেকটা সময়। ক্ষুধার কথা বলে বাবার কোলেই একপর্যায়ে ঘুমিয়ে যায় নূহা।
সেই মুহূর্তটি : ডুলাহাজারার পর খুটাখালী মেদাকচ্ছপিয়া এলাকায় মোড় নেওয়ার সময় দেখা যায় রাস্তার ওপর গাছের ডাল ফেলে রাখা হয়েছে। তখন রাত ৩টার মতো বাজে। তরুণ সমূহ বিপদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে চালককে বললেন, ডালটি পেরিয়ে দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য। চালক খানিকটা ধীর গতিতে ডাল পেরিয়েও যায়। ঠিক ওই সময় বিকট একটি শব্দ হয়। ভেঙে যায় গাড়ির গ্লাস। সবাই বুঝতে পারেন গাড়িতে গুলি করা হয়েছে। তীব্র ব্যথা অনুভব করে তরুণ বললেন, তাঁর বাঁহাতে গুলি লেগেছে। ঠিক তখন তাঁর বন্ধু রিপন চিৎকার করে উঠে বলেন, তোমার মেয়ের দিকে তাকাও। তরুণ দেখেন, নূহা কোলেই ঢলে পড়েছে। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। বুঝতে বাকি রইল না গুলি তাঁর হাত ভেদ করে মেয়ের মাথায় আঘাত করেছে। দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানেই নূহাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
তরুণ বলেন, 'আমি কী মনে করে মেয়ের বুকে চাপ দিয়েছিলাম। দেখলাম সে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে। হাসপাতালে যখন চিকিৎসা দিচ্ছিল ডাক্তার তখন আমি চিৎকার করে বললাম, 'মারে তুমি কক্সবাজার চলে এসেছো। একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখো। আমার মেয়ে যেন তখন আমার কথা বুঝতে পারছিল। সে বাঁ চোখ দিয়ে তাকায়। চোখ খোলা রেখেই আমাদের সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যায় সে।'
তরুণ বলেন, 'সেদিন যদি ডাল দেখে দাঁড়িয়ে যেতাম, তাহলে হয়তো এমন ঘটনা ঘটত না। আমি আবার যদি সেই দিনটিতে ফিরে যেতে পারতাম।'
মর্মান্তিক এ ঘটনার পর মেয়ের লাশ নিয়ে তরুণ নোয়াখালী গ্রামের বাড়ি চলে যান। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করে ফিরে আসেন ঢাকায়। ঘটনার পর থেকে তিনি ও তাঁর স্ত্রী স্বাভাবিক হতে পারছেন না। পুরো পরিবার বিপর্যস্ত। কান্না যেন তাঁদের সঙ্গী হয়ে গেছে।
গত সোমবার দুপুরে রাজধানীর হাতিরপুলের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ৩৭৩/১৭ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা গেছে তরুণ তাঁর মেয়ের পুতুল জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। বন্ধু ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ডা. তৌফিক জোয়ার্দার সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁকে। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই তাঁকে শান্ত করতে পারছিল না।
বেড়ানো পছন্দ ছিল নূহার : তরুণ জানান, ২০০৭ সালের ৭ আগস্ট জন্মগ্রহণ করে নূহা। জন্মের পর তাকে নিয়ে চারবার কক্সবাজার বেড়াতে গেছেন। নূহা যখন বুঝতে শিখেছে, তখনই কক্সবাজারের কথা বলতেই খুব খুশি হতো। মেয়ের আনন্দ দেখার জন্যই তাঁরা কক্সবাজার যেতে আগ্রহী ছিলেন বেশি। তিনি জানান, ২৯ জুন রাতে নূহা ঘুমাতে পারছিল না। তখন তরুণ জানতে চান সে ঘুমাচ্ছে না কেন। জবাবে নূহা বলে, 'কাল কক্সবাজার যাব, এই আনন্দে ঘুম আসছে না। খুব আনন্দ লাগছে।' এই আনন্দই যে তার শেষ আনন্দ হবে সেটা কে জানত_বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তরুণ। আর তাঁর মুখ দিয়ে যেন কথা বেরোচ্ছিল না। শুধু তরুণ কেন, তাঁর বাসায় উপস্থিত তাঁর বন্ধু ডা. তৌফিক জোয়ার্দারেরও অশ্রু ঝরছিল।
চার ডাকাত গ্রেপ্তার : মর্মস্পর্শী এ ঘটনায় কক্সবাজার থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন তরুণের বন্ধু রিপন। পরে সেটিকেই এজাহার হিসেবে ধরে নিয়ে চকরিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। চকরিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ফরহাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঘটনার দুই দিন পরই আমরা চার ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছি।' জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, তারা ১৬ থেকে ১৭ জন ডাকাতির উদ্দেশ্যে রাস্তায় গাছের ডাল ফেলে রেখেছিল। গাড়িটি ডাল পেরিয়ে চলে যাওয়ার কারণে গুলি করেছে। তিনি জানান, এই ডাকাতদের এর আগেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কয়েক মাস আগে জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও ডাকাতি শুরু করেছে। তিনি আরো জানান, তাদের অন্য সহযোগীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger