কান্নাভরা স্মৃতিচারণা by প্রণব বল ও শারফুদ্দীন কাশ্মীর

ঝোরে কাঁদছে জেসমিন আক্তার। মাইক্রোফোনের সামনে কান্না চাপতে চোখ ও মুখে হাত চাপা দেয় সে। কান্নার শব্দ আসতে থাকে মঞ্চ ও সামনের দিক থেকেও। নিঃশব্দেও চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে অনেকের। জেসমিন মিরসরাইয়ের আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। মিরসরাইয়ে গত সোমবার মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রদের স্মরণে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত শোকসভায় স্মৃতিচারণা করছিল সে। কিন্তু বারবার কান্না থামিয়ে দেয় তাকে। স্মৃতিচারণা করতে আসা অন্য শিক্ষার্থীরাও কেঁদেছে। কেঁদেছেন শিক্ষক-অভিভাবকেরা। স্মৃতিচারণা শুনে কেঁদেছেন সমবেত মানুষেরা।

এই শোকসভা হয় আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে উপজেলা পরিষদের তিন দিনের শোক কর্মসূচির শেষ দিন ছিল গতকাল।
সকালে প্রথমে হয় শোকযাত্রা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সকাল ১০টায় স্কুল থেকে শুরু হয় শোকযাত্রা। আবুতোরাব ও আশপাশের এলাকা প্রদক্ষিণ করে এটি স্কুলমাঠে গিয়ে শোকসভায় মিলিত হয়। গতকালও ওই বিদ্যালয়ে ক্লাস হয়নি। ওই দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবে নিহত ৩৯ জনের মধ্যে ৩৭ জনই শিক্ষার্থী। এদের বেশির ভাগই আবুতোরাব উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র।
বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আয়োজিত শোকসভা। এলাকার মতোই শোকের আবহ মাঠজুড়ে। কালো ব্যানারে শোকবার্তা। উপস্থিত সবার বুকে কালো ব্যাজ। মুখে শোকের গভীর ছায়া, যা কান্না হয়ে বেরিয়েছে স্মৃতিচারণার সময়।
শোকসভার শুরুতে ন্যাশনাল ব্যাংকের দেওয়া নিহত ছাত্রদের পরিবারপ্রতি ২০ হাজার টাকা অনুদানের চেক প্রদান করা হয়। এই চেক হাতে নিয়ে নিহত সাইদুলের মা জাহানারা বেগম বলেন, ‘আমার টাকার দরকার নেই। আমার সাইদুলকে এনে দাও।’
শোকসভায় নিহত সহপাঠীদের স্মৃতিচারণার সময় জেসমিনের মতো নুসরাত জাহান, তানভির হোসেন, সাইদুর রহমান, সৌরভ হোসেনরা কেঁদেছে। কেঁদেছে অন্য সহপাঠীরাও। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাদের সামলানোর চেষ্টা করে অন্যরা। কালো ব্যাজ ধারণ করে একসময় মঞ্চে ওঠে ওই দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন ছাত্র।
শোকসভার সভাপতি আবুতোরাব উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেকও কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রাণের যেসব শিক্ষার্থী হারিয়েছি, তাদের আমরা কোনো দিন ভুলব না। তবে এই শোক আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। সবাইকে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী হতে হবে।’ তিনি অভিভাবকদেরও সহযোগিতা কামনা করেন। দুর্ঘটনার পর আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতা দেওয়ায় তিনি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জানান।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ লকিয়ত উল্লাহ বলেন, ‘দুর্ঘটনায় এত প্রাণ চলে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারে না। আমরা নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’
বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোমিনুল হকের পরিচালনায় শোকসভায় আরও বক্তব্য দেন সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর কবির, শিক্ষক সমিতির সীতাকুণ্ড শাখার সভাপতি হাবিবুল্লাহ, চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সাধারণ সম্পাদক জানে আলম, প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষ মো. নুরুল আবছার, মিরসরাই পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি উত্তম শর্মা, স্কুল পরিচালনা পরিষদের সদস্য সুভাষ নাথ, মফিজুল ইসলাম, গোলাম সরওয়ার, শিক্ষক সমীরণ বড়ুয়া, রবিউল হোসেন নিজামী প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, আমরা যেসব ছাত্রকে হারিয়েছি, তারা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দিত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য। আমরা আর এমন মৃত্যু চাই না। বক্তারা শিক্ষার্থীদের সাবধানতার সঙ্গে চলাফেরা করার পরামর্শ দেন।
সভার শুরুতে নিহত ছাত্রদের স্মরণে দোয়া মাহফিল ও নিহত অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রার্থনা এবং শেষে মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। বেলা দুইটার দিকে শেষ হয় শোকসভা।
সর্বত্র শোক: মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া সড়ক দিয়ে ঢুকতেই দুই পাশে কালো ব্যানার। দুর্ঘটনাস্থল আবুতোরাবের সৈদালী এলাকার ওই ডোবায়ও কালো ব্যানারে শোকবার্তা। এর কিছুদূরে আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে কালো ব্যানার, শিক্ষার্থীদের সাদা পোশাকের সঙ্গে কালো ব্যাজ। মাইকে ভেসে আসে শোক কথামালা।
এলাকার দোকান, স্কুল-কলেজ, খেলার মাঠ, মিরসরাইয়ের প্রতিটি বাজার, উপজেলা পরিষদ—সর্বত্র উড়ছে কালো পতাকা। নিহত ছাত্রদের বাড়িতে বাড়িতে মাতম।
শোকাবহ পরিবেশে গতকাল নিহত ছাত্রদের কুলখানি ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।
সরকারটোলা এলাকায় নিহত সূর্য নাথের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান চলছে। কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তার মা ডলি ও বাবা খোকন নাথ। ওই দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সূর্যর বড় ভাই দশম শ্রেণীর ছাত্র শুভ নাথ বসে ছিল বিমর্ষ মনে।
আবুতোরাব উচ্চবিদ্যালয়ে যোগাযোগমন্ত্রী: বেলা দুইটার দিকে আবুতোরাব স্কুলে যান যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে বসে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর সঙ্গে দুর্ঘটনার বিষয়ে কথা বলেন। তিনি এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনা রোধে যানবাহন চালানোর সময় চালকদের মুঠোফোন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হবে। এ নিয়ে বুধবার একটি আইন প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগির এটি মন্ত্রিপরিষদে উত্থাপন করা হবে।
মন্ত্রী আরও বলেন, লাইসেন্সবিহীন চালককে যে মালিক গাড়ি চালাতে দেবেন, সেই মালিকের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে নিহত ছাত্রদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি আশ্বাস দেন, নিহত শিক্ষার্থীদের ভাইবোনদের কেউ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে মন্ত্রীর নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনা খরচে তাদের পড়ার ব্যবস্থা করবেন।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger