দৃষ্টিনন্দন ফুরানোর ফুলরাজি by এমএ ফারুখ

জাপানের সর্ব উত্তরের দ্বীপ হোক্কাইডোর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি চমৎকার শহরের নাম 'ফুরানো'। শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে পাহাড়-পর্বত এবং বনাঞ্চল। তবে এই পাহাড়-পর্বতের গায়ে চাষ করেই ফুরানো কৃষিপ্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সমগ্র জাপানে গাজরের চাহিদার সিংহভাগ উৎপাদিত হয় ফুরানো থেকে। চমৎকার আবহাওয়া, নৈসর্গিক শোভা, অপেক্ষাকৃত বড় দিনদৈর্ঘ্য এবং ঈষৎ ঠাণ্ডা রাত ফুরানোতে কৃষিকাজের জন্য যথোপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।

জাপানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে ফুরানো একটি বিখ্যাত পর্যটনস্থল মূলত দুটি কারণে। এর একটি হলো ফুরানোর অতি সুপরিচিত ও সুপ্রসিদ্ধ 'ল্যাভেন্ডার ফিল্ড' এবং দ্বিতীয়টি হলো 'স্কি রিসোর্ট', যা প্রধাণত ইউরোপ, আমেরিকার পর্যটকদের কাছে সমধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ফুরানোর সবচেয়ে বড় ল্যাভেন্ডার ফিল্ডটি 'তমিতা ফার্ম' এর অংশ। তমিতা ফার্মটি হোক্কাইডোর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ফুলের ফার্ম। এটি মূলত একটি ল্যাভেন্ডার ফার্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও এখন এখানে বৃহদাকারে চেরি, টিউলিপ, লুপিনসহ বহুবিধ ফুলের চাষ হয়। শত শত হেক্টর জায়গা নিয়ে গঠিত এই ফার্মের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানটির নাম 'রেইনবো ফিল্ড', যেখানে বিভিন্ন বর্ণের ফুলের সারি খুব সন্তর্পণে পাহাড়ের গা বেয়ে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। তমিতা ফার্মে একটি 'গ্রিনহাউস' রয়েছে, যেখানে সারাবছরই কিছু ফুলের চাষ করা হয় পর্যটকদের জন্য। ফার্মে ঢুকতে কোনো প্রবেশ ফি দিতে হয় না এবং যতক্ষণ ইচ্ছা সময় কাটানো যায়।
তমিতা ফার্মের কর্ণধার হলেন তাদাও তমিতা, যিনি ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং প্রায় তিন পুরুষ ধরে হোক্কাইডোতে বসবাস করছেন। তাদাও তমিতা ২৫ বছর বয়স থেকে ফুরানোতে ল্যাভেন্ডারের চাষ শুরু করেন। সে সময় তমিতা ফার্মের এই প্রধান কর্তাব্যক্তিটির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ফুরানোর ঠাণ্ডা ও শুকনো আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে ল্যাভেন্ডার থেকে সুগন্ধী দ্রব্য তৈরি করা। ষাটের দশকে জাপানের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতির প্রাক্কালে তাদাও তমিতার ল্যাভেন্ডার ফার্মের কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে ৪০০ হেক্টরে উন্নীত হয়। কিন্তু এই দশকের শেষের দিকে জাপানের ক্রমবর্ধমান অতি আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ভাটা পড়ে তমিতার ল্যাভেন্ডার ফার্মের অগ্রগতিতে। মানুষ ঝুঁকে পড়ে কৃত্রিম প্রসাধনীর দিকে। ফুরানো এলাকায় তমিতার কাজে ও সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যারা ল্যাভেন্ডার চাষে আগ্রহী হয়েছিলেন, তারা প্রায় সবাই ল্যাভেন্ডার ফার্মের কাজ গুটিয়ে অন্য কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি তাদাও তমিতা। তিনি মনেপ্রাণে জানতেন সুসময় একদিন আসবে, মানুষের কৃত্রিমতার ঝোঁক সাময়িক মাত্র। এর পরের কাহিনী বেশ চমকপ্রদ। তমিতার অর্থনৈতিক ও মানসিক খরার কোনো এক সকালে একজন সাংবাদিক অভ্যাসবশত ল্যাভেন্ডার ফার্মের কিছু ছবি তুলে নিয়ে যান। এই ছবিগুলোর একটি পরবর্তী বছরে জাপান রেলওয়ে জাতীয় ক্যালেন্ডারের জুন পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। এরপর তমিতাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন প্রতিবছর মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অসংখ্য পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে তমিতার ল্যাভেন্ডার ফার্ম।
মে মাসের হালকা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় যখন চারদিকে ঘেরা পাহাড় থেকে ঝিরিঝিরি বাতাস বইতে থাকে, যখন ছোট ছোট মেঘরাশি সেই পাহাড়ে আছড়ে পড়ে রৌদ্রস্নাত ধোঁয়ার আস্তরণ তৈরি করে, ঠিক সে সময়ে চারদিকের অবারিত, সি্নগ্ধ, অপার অসীম সুন্দর ফুলরাজির মাঝে নিজের দৃষ্টিকে তৃপ্ত করার মতো ভালো স্থান আর হতে পারে না। চেরি, টিউলিপ, লুপিন, পপি এবং জার্মানিকা'র দৃষ্টিনন্দন রঙ এবং চাপা মিষ্টি গন্ধ মনটাকে সি্নগ্ধ করে তোলে, মনে হয় এটি পৃথিবীর মাঝে একটি ছোট্ট স্বর্গ। এই ফার্মে ফুল চাষের ক্রমবিন্যাস ঠিক করা হয় ফোটা ফুলের রঙের কথাটি বিবেচনায় রেখে। সে জন্যই ফুল ফোটার পর তার রঙ বৈচিত্র্য ও বিন্যাস মানুষকে বিমোহিত করে। পর্যটকদের কাছে এখানে আসার সবচেয়ে আকর্ষণীয় সময়টি হলো জুলাই মাস। কারণ জুলাই মাসে মাঠে প্রায় ৯ ধরনের ফুল ফোটে; লাল টকটকে পপি, হলুদাভ ও হালকা লাল গোলাপ, হলুদ সরিষা, গাঢ় সবুজ ঝোপালো গাছে সাদা আলুর ফুল, পিংক রঙের জাপানিজ গোলাপ, পারপল ল্যাভেন্ডার, হলুদ ও কমলা গাঁদা, গাঢ় হলুদ সুর্যমূখী এবং লাল ও হলুদাভ রঙের মিশ্রণে স্কারলেট সেজ। মাঠের পর মাঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই ফুলগুলোর সারি তাদের রূপমাধুর্য দিয়ে দর্শকদের দৃষ্টি ও চিত্ত নন্দিত করে। ফুরানোর ফুলরাজির র্নিমাণশৈলী ও তার উপস্থাপন কৌশল যেন মানুষকে মুগ্ধ, বিমোহিত করে তার স্মৃতিপটে বহু দিনের জন্য জায়গা করে নেয়। নিষ্কলুষ ফুল মানুষকে শিক্ষা দেয় সি্নগ্ধ, নমনীয়, পবিত্র এবং উদার হতে।
সাপ্পোরো, হোক্কাইডো, জাপান
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger