মেয়েটির জন্য কারও মায়া হলো না!

৪ বছরের কিশোরী হেনা ৭০-৮০টি দোররার আঘাতের পর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার আগে ছোট্ট এই মেয়েটি সয়েছে ধর্ষণের ভয়ংকর শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা। মৃত্যু তাকে হয়তো সব যন্ত্রণা আর এই কুৎসিত সমাজ থেকে মুক্তি দিয়েছে।

হেনার ফুফাতো বোনসহ আত্মীয়রা জানান, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চামটা গ্রামের দরিদ্র কৃষক দরবেশ খাঁর মেয়ে হেনা। গত রোববার দিবাগত রাতে মেয়েটি প্রাকৃতিক কাজে ঘরের বাইরে যায়। এ সময় তার দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই মাহাবুব (৪০) তার মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে পাশে তার পরিত্যক্ত একটি ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করেন। মেয়েটির চিৎকারে প্রথমে মাহাবুবের স্ত্রী ও ভাই বেরিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁরা মেয়েটিকে উল্টো মারধর করেন। একপর্যায়ে হেনার বাবা-মা, ভাই-বোনসহ বাড়ির লোকজন বের হয় এবং মেয়েটিকে উদ্ধার করে। হেনাদের ঘর থেকে মাহাবুবের ঘরের দূরত্ব ২০-২৫ গজ হবে বলে জানিয়েছে স্বজনেরা।
নড়িয়া থানা ও এলাকার সূত্র জানায়, ঘটনা জানাজানি হলে পরের দিন সোমবার চামটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ইদ্রিস ফকিরের নেতৃত্বে সালিস বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সালিসে উপস্থিত হন চামটা আবুল বাশার মাদ্রাসার শিক্ষক সাইফুল ও গ্রামের মসজিদের ইমাম মফিজ উদ্দিন। ইদ্রিস ফকির, লতিফ মীরমালত, আক্কাস, ইয়াসিন ও জয়নাল মীরমালতের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের বিচারক বোর্ড গঠন করা হয়। তাঁরা ইমাম ও মাদ্রাসার শিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করে ধর্ষণকারী ও ধর্ষণের শিকার কিশোরী উভয়কেই দোররা মারার রায় দেন। মাহাবুবকে ২০০ দোররা ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আর কিশোরী হেনাকে ১০০ দোররা মারার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু ধর্ষকের শাস্তি অর্ধেক কমিয়ে তাৎক্ষণিক সালিসকারীরা তাঁকে ১০০ দোররা মারেন। হেনাকে ৭০-৮০টি দোররা মারার পর সে অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। স্বজনেরা তাকে উদ্ধার করে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাতে হেনা মারা যায়।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে জানান, সোমবার রাতে জরুরি বিভাগে ভর্তি করার কিছুক্ষণ পরই হেনা মারা যায়।
সালিসকারীরা হেনার মৃতদেহ গ্রামে নিয়ে তড়িঘড়ি দাফনের উদ্যোগ নেন। খবর পেয়ে পুলিশ গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মরদেহ উদ্ধার করে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ইউপি সদস্য ইদ্রিস ফকির, ধর্ষক মাহাবুব ও সালিসকারীরা পালিয়ে যান। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধর্ষক মাহাবুবের স্ত্রী, জয়নাল মীরমালত, আলাবক্স করাতি ও ইমাম মফিজ উদ্দিনকে আটক করে। শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার শহিদুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
হেনার বাবা দরবেশ খাঁ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি গরিব হওয়ায় প্রভাবশালীরা আমার মেয়ের সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন। এভাবে দোররা মেরে মেয়েটিকে মেরে ফেলা হবে, কখনো ভাবিনি। আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’
মাহাবুবের স্ত্রী দাবি করেন, তাঁর স্বামীর সঙ্গে অসামাজিক কাজ করায় গ্রামের মানুষ হেনাকে আটক করে মারধর করে। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে মারধর করেছেন।
চামটা ইউপির চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন রাঢ়ী বলেন, ‘ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ভাবতেই লজ্জা লাগছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।’
পুলিশের হাতে আটক সালিস বৈঠকে উপস্থিত থাকা আলাবক্স করাতি বলেন, ‘দোররা মারার ফতোয়া আমরা দিইনি। প্রভাবশালী সালিসকারীদের চাপের মুখে এর প্রতিবাদ করতে পারিনি। মেয়েটির এমন পরিণতি হবে বুঝতে পারলে প্রতিবাদ করতাম।’
আটক হওয়া ইমাম মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘দোররা মারার রায় ঘোষণা করেছেন বিচারকেরা। উপস্থিত অন্যরা তা বাস্তবায়ন করেছেন। তবে সালিসকারীরা আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। আমরা বলেছি, ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই শাস্তি পেতে হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল রাতে জানান, ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের ফকির গতকাল রাত নয়টার দিকে জানান, হেনার মৃতদেহ উদ্ধার করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। মেয়েটির বাবা বাদী হয়ে গ্রেপ্তার হওয়া চারজনসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
পুলিশ সুপার এ কে এম শহিদুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হবে।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger