নিয়ম না মেনে পুরোনো জাহাজ আসছে, ভাঙাও চলছে

ট্টগ্রামে ভাঙার জন্য আরও চারটি পুরোনো জাহাজ আমদানি করা হয়েছে। এ নিয়ে গত এক মাসে ভাঙার জন্য ৩০টি জাহাজ আনা হলো। উচ্চ আদালতের নির্দেশ আর আন্তর্জাতিক বর্জ্য চলাচলবিষয়ক সনদ অমান্য করে এই জাহাজগুলো আনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতিও নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ভাঙার জন্য পুরোনো জাহাজ (স্ক্র্যাপ) আমদানির আগে রপ্তানিকারক দেশ থেকে বর্জ্যমুক্ত সনদ (প্রি-ক্লিনিং সার্টিফিকেট) নিতে হবে। থাকতে হবে পরিবেশ ছাড়পত্র। আদালতের এ নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ আমদানিকারক তা অমান্য করে চলেছেন।
গত ১৮ জানুয়ারি ম্যাক করপোরেশনের আমদানি করা এমভি প্রণাম নামের একটি পুরোনো জাহাজ কাটার সময় বর্জ্যের কারণে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণে চারজন শ্রমিক নিহত হন। আটজন আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন।
গত বছর প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে জাহাজভাঙা শিল্পে পরিবেশসম্মতভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ নির্দেশের পর এখন পর্যন্ত একটি জাহাজভাঙা ইয়ার্ডও নিয়ম মেনে ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেনি।
এদিকে বিভিন্ন দেশের ৪৮টি পরিবেশবাদী ও শ্রমিক অধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি খোলা চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের বেশির ভাগ বর্জ্যযুক্ত জাহাজ নিজেদের দেশে বর্জ্যমুক্ত না করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে তারা উচ্চ আদালতের নির্দেশ ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে পুরোনো জাহাজ আমদানির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছে।
আন্তরাষ্ট্রীয় বর্জ্য চলাচলবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ (ভেসেল কনভেনশন) অনুযায়ী পুরোনো জাহাজ একটি বর্জ্য। রপ্তানিকারক দেশকে বর্জ্যমুক্ত করে আমদানিকারক দেশে পাঠানোর শর্তযুক্ত এই কনভেনশন তৈরি হয় ১৯৮৯ সালে। বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করলেও এটি মেনে চলে না। মানে না রপ্তানিকারক দেশগুলোও।
মন্ত্রীর জিনতত্ত্ব: গত ২৯ জানুয়ারি পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ চট্টগ্রামে জাহাজভাঙা শিল্পের পক্ষে বক্তব্য দেন। চট্টগ্রাম চেম্বার আয়োজিত ‘পরিবেশ রক্ষায় শিল্পপতিদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মূলত জাহাজভাঙা শিল্প নিয়ে আলোচনা হয়। হাছান মাহমুদ সেখানে বলেন, ‘আমি জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য অনেক কিছু করেছি। কিন্তু এই শিল্পের ওপর খারাপ জিনের আছর পড়েছে। এই জিন হাইকোর্টের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করে। এই জিনের সঙ্গে বিদেশিদের যোগাযোগ রয়েছে। তারা বাংলাদেশে লোহার ব্যবসা করতে চাইছে।’
এদিকে জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের পক্ষে পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীর প্রকাশ্য অবস্থানের পর পরিবেশ অধিদপ্তর দ্রুততার সঙ্গে ছাড়পত্র দেওয়া শুরু করেছে। এ মাসে মোট ৪৪টি ইয়ার্ডকে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। এর আগে অক্টোবরে ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ফলে এখন জাহাজভাঙার পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়া ইয়ার্ডের সংখ্যা দাঁড়াল ৬০টি। সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের সংখ্যা মোট ১৩৫। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলের শেষ দিকে এই সংখ্যা ছিল ৬০-৬৫।
জানা গেছে, জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোতে শ্রমিকের মৃত্যু ও নিয়ম না মানার বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির গত সভায় আলোচনা হয়েছে। সভায় হাছান মাহমুদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কীভাবে শর্ত সাপেক্ষে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। উত্তরে মন্ত্রী বলেছেন, ছাড়পত্র পাওয়া ৪৪টি ইয়ার্ডের বেশির ভাগই ৭৫ শতাংশ শর্ত মেনে কাজ করছে।
১২ বা ১৩ ফেব্রুয়ারি সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিবেশ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিনিধিদল চট্টগ্রামে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। তারা জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলো পরিদর্শন করবে।
এ ব্যাপারে সাবের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ও পরিবেশ-সংক্রান্ত নিয়মকানুন না মানার অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। ঢাকায় বসে পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন না করে তাঁরা সরেজমিনে গিয়ে দেখতে চান বলে জানান।
আদালতের নির্দেশ অমান্য: ২০০৯ সালের অক্টোবরে ১৬টি জাহাজভাঙা ইয়ার্ডকে ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত থেকে বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী ছাড়পত্র নিতে হবে। শর্ত সাপেক্ষে ছাড়পত্রের কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর ওই নির্দেশকে পাশ কাটিয়ে ১৬টির ছাড়পত্র বহাল রাখার পাশাপাশি নতুন করে আরও ছাড়পত্র দেয়।
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, বহির্নোঙরে গত সোমবারও ভাঙার জন্য আনা চারটি জাহাজ অপেক্ষা করছিল। এ নিয়ে গত তিন মাসে ভাঙার জন্য আমদানি হয়েছে ৩০টি জাহাজ। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত অক্টোবরের পর ২৬টি জাহাজ আমদানির ছাড়পত্র দিয়েছি। অন্য চারটি জাহাজ কীভাবে এল, আমরা জানি না।’
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ৫ ও ১৭ মার্চ হাইকোর্টের রায়ে সব পুরোনো জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ও রপ্তানিকারক দেশের ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এই আদেশ না মেনে জাহাজ আমদানির অনুমতি দিতে শুরু করে। এরপর রেকর্ডসংখ্যক ১৭২টি জাহাজ আসে। বিষয়টি বেলার পক্ষ থেকে জানানো হলে হাইকোর্ট গত বছরের ১১ মে আরেক আদেশে আবারও সব ধরনের জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ও রপ্তানিকারক দেশের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, আমদানিকারকদের পৃথক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এসব জাহাজ একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সরেজমিন পরিদর্শনের পর ভিড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এই নির্দেশনা মেনে কাজ করেছি। তবে কোনো জাহাজ কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অনুমোদন ছাড়া জাহাজ কাটার সময় বিস্ফোরণে চার শ্রমিক নিহত হওয়ায় আমরা ম্যাক করপোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি।’
এ প্রসঙ্গে জাহাজভাঙার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সাবেক সহসভাপতি কামাল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা আছে বলে আমি কোনো জাহাজ আমদানি করিনি। এখন আমদানি করা জাহাজ ভাঙতে গিয়ে অনেকে হত্যা মামলার আসামি হচ্ছেন।’
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger