চুক্তি, মিটারে প্রতারণা, গন্তব্যে না যাওয়ার হয়রানিতে যাত্রীরা

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আল-আমিন মতিঝিল শিল্প ব্যাংক ভবনের সামনে সিএনজিচালিত অটোরিকশার খোঁজ করতেই পেয়ে যান (ঢাকা মেট্রো থ-১২-৭২৫৮)। একেবারেই মিটারে যেতে রাজি হয়েছেন চালক। যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! তবে অটোরিকশাটি ফকিরাপুল পানির ট্যাংক পর্যন্ত আসার পর ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়ে।

আদালত দেখতে পান, আধা কিলোমিটার রাস্তা পার হয়েছে, কিন্তু ভাড়া উঠেছে ২৯ টাকা। অর্থাৎ মিটার কারসাজি করা। চালক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘অফিস থেকে মিটার ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সিলগালা করা হয়নি।’ আদালত চালককে ৫০০ টাকা জরিমানা করেন।
বিআরটিএর পরিদর্শক জয়নাল আবেদীন বলেন, প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ২৫ টাকা। এ দুই কিলোমিটার পার না হওয়ার আগ পর্যন্ত মিটারে ওয়েটিংয়ের ভাড়া উঠবে না। সে ক্ষেত্রে ২৯ টাকা ওঠা মানে মিটার কারসাজি করা। অর্থাৎ মিটারে অতিরিক্ত ভাড়া উঠবে।
বিআরটিএ ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে রাজধানীতে পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয় গতকাল। এসব আদালত যেকোনো গন্তব্যে যাত্রী বহন না করা, চুক্তিতে যাত্রী বহন ও মিটারে কারসাজির অনিয়ম পেয়েছেন।
গতকাল বিকেলে যখন শাহবাগে ভ্রাম্যমাণ আদালত চলছিল, তখন একটু দূরের কাঁটাবন মোড়ে আধঘণ্টা অপেক্ষা করে পুরান ঢাকার বংশালে যাওয়ার জন্য কোনো চালককে রাজি করাতে পারেননি আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত নির্দিষ্ট স্থানে থাকেন। তাঁদের কাছ থেকে ৫০০ মিটার দূরে গিয়ে কোনো চালককে বলেন, দেখবেন যাবে না। তাদের সঙ্গে তো মারামারি করতে পারব না।’
নিউমার্কেটের সামনে সারিকা সরকার বলেন, ঢাকা মেট্রো থ-১৪-০৬৭৩ অটোরিকশার চালক যাওয়া তো দূরের কথা, রীতিমতো তাঁকে বকাঝকা করেছেন। তিনি জানান, পুলিশে খবর দেওয়ার কথা বলায় ওই চালক উল্টো তাঁকে অপমান করেন।
রাজধানীর ফকিরাপুল, রমনা, শাহবাগ, তেজগাঁও বিজি প্রেস ও মানিক মিয়া এভিনিউয়ে পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। এতে ১৩২টি মামলা এবং ৯২ হাজার ৬৯০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একটি অটোরিকশা জব্দও করা হয়েছে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে ফকিরাপুল এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত চলাকালে প্রায় ২৫-৩০টি অটোরিকশা থামানো হয়। এর মধ্যে মাত্র দুটি অটোরিকশার মিটার সঠিক পাওয়া যায়। ঢাকা মেট্রো থ-১৪-৩৭১৭ অটোরিকশার কাগজ পরীক্ষা করে দেখা যায়, গাড়িটির বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। এগুলোর কোনোটিই নিষ্পত্তি হয়নি। মিটার ঠিক না থাকায় আদালত ওই গাড়ির চালক মোজাম্মেল হককে ৫০০ টাকা জরিমানা করেন।
রমনা এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেলিম হোসেন। তিনি বলেন, অধিকাংশ অটোরিকশা মিটারের পরিবর্তে চুক্তিতে এসেছে। এ ছাড়া গাড়িগুলোর কাগজপত্র সঠিক পাওয়া যায়নি।
মানিক মিয়া এভিনিউয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তোফায়েল ইসলাম। দুপুর দুইটা পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত সিএনজিচালিত প্রায় ৫০টি অটোরিকশা পরীক্ষা করে মাত্র তিনটির মিটার বিআরটিএর সিল করা পায়। ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, অধিকাংশ মিটারই কারসাজি (টেম্পারিং) করা। তবে তোফায়েল ইসলাম অভিযোগ করেন, অটোরিকশা দাঁড় করানোর পর ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনেক যাত্রী মিটারে না এসেও মিথ্যা বলেন। এতে চালকেরা পার পেয়ে যায়। জনস্বার্থে হলেও ভ্রাম্যমাণ আদালতকে সাহায্য করার আহ্বান জানান তিনি।
এ ছাড়া শাহবাগ এলাকায় রনি চাকমা ও তেজগাঁওয়ে সাকিল আহমেদ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন।
মিটার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত সিএনজিচালিত অটোরিকশার চাকা এক হাজার ৬৫০ বার ঘুরলে এক পালস বা এক কিলোমিটার হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু কারসাজি করা মিটারগুলোতে কোনো কোনোটা ৯০০ বার ঘোরার পরই এক কিলোমিটার দেখায়। কিছু মিটারে এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ বার ঘোরার পর এক কিলোমিটার হচ্ছে।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান আয়ুবুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, মালিক-চালক দুই পক্ষই মিটারে যাওয়া ও সরকার নির্ধারিত হারে জমা নেবে বলে অঙ্গীকার করেছে। প্রথম দিন ভ্রাম্যমাণ আদালতে চালকের কারাদণ্ড বা অটোরিকশা ডাম্পিং করা হয়নি। তবে আজ বৃহস্পতিবার থেকে তা হবে।
তবুও তাঁরা যান না: সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা দৈনিক ১৫০ কিলোমিটার চলে—এটাকে ভিত্তি ধরেই বিআরটিএ ভাড়ার হার নির্ধারণ করেছে। সঙ্গে মালিকের লাভ, জ্বালানি খরচ, চালকের বেতন, খরচসহ অন্য ব্যয়ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
তবে অটোরিকশাচালকেরা জানিয়েছেন, দৈনিক তাঁরা গড়ে ১৭০ কিলোমিটার পথ চালান। এই পথের মধ্যে অন্তত ২৫ বার নতুন যাত্রী তুলে থাকেন।
বর্তমানে অটোরিকশায় প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ২৫ টাকা। ২৫ বার নতুন যাত্রী তুললে প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া আসে ৬২৫ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া সাত টাকা। সেই হিসাবে বাকি ১২০ কিলোমিটারের ভাড়া আসে ৮৪০ টাকা। সারা দিনে ওয়েটিংয়ে (যাত্রাবিরতী, সিগনাল ও যানজট) আরও অন্তত ২০০ টাকা ভাড়া আসে। সেই হিসাবে দিন শেষে তাঁদের আয় হয় এক হাজার ৬৬৫ টাকা। জ্বালানি খরচ দৈনিক ১৫০ টাকার বেশি হয় না।
বিআরটিএর কর্মকর্তাদের হিসাব মতে, মিটার অনুযায়ী চলাচল করলে সারা দিনের খাওয়ার খরচ, জ্বালানি ও সামান্য মেরামত বাদ দিলে দৈনিক অন্তত ৫০০-৬০০ টাকা থাকে চালকের। এত টাকা আয়ের পরও চালকেরা মিটারে না গিয়ে যাত্রীদের পকেট কাটছেন। স্বল্প দূরত্বের ক্ষেত্রে তো একেবারে ‘না’ বলে দিচ্ছেন।
চালকদের দাবি, যানজটের কারণে বেশি ট্রিপ দেওয়া যায় না। এত দিন মালিকেরা বেশি জমা নিতেন। এখন অধিকাংশ মালিক ৬০০ টাকা জমা নেন। তবে তাঁরা ১২ ঘণ্টার বেশি চালাতে দেন না।
মালিকদের নতুন ফন্দি: রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও ও মান্ডা এলাকায় সবচেয়ে বেশি অটোরিকশার গ্যারেজ। এসব এলাকায় ঘুরে জানা গেছে, এত দিন মালিকেরা সকাল থেকে গভীর রাত অবধি ৭০০-৮০০ টাকা জমা নিতেন। সরকার জমা ৬০০ টাকা নির্ধারণ করার পর তাঁরা নতুন ফন্দি এঁটেছেন। অনেকেই চালকদের ৬০০ টাকার বিনিময়ে সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা বেঁধে দিয়েছেন।
মানিক মিয়া এভিনিউয়ে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে চালক আবদুর রব, মহিরউদ্দিন, শাহজাহান ও জসিম উদ্দিনও দাবি করেন, ১২ ঘণ্টার পালা শেষ হওয়ার পর মালিক পুনরায় অন্য চালককে অটোরিকশা ভাড়া দিয়ে থাকেন।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দৈনিক বাংলার মোড়ে ঢাকা মেট্রো থ-১৪-০৭৭৫ নম্বরের অটোরিকশার চালককে পায়ে ধরার বাকি রাখেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফুজায়েল আহমেদ। কিন্তু চালকের এক কথা, যাবেন না। কেন যাবেন না প্রশ্ন করা হলে বলেন, মালিক সন্ধ্যার পর চালাতে নিষেধ করেছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর সিএনজিচালিত অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ ভুলু প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, কিছু কিছু মালিকের বিরুদ্ধে দুই ভাগে ভাগ করে অটোরিকশা ভাড়া দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসব মালিককে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মিলি বিশ্বাস বলেন, যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী চালকেরা যেতে বাধ্য। যাঁরা মিটার অনুযায়ী যান না, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। পর্যায়ক্রমে আইনের প্রয়োগ আরও কঠিন হবে।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger