সহজে ব্যাংক ঋণ পেয়ে ধান মজুদের হিড়িকঃ চালের দাম বাড়ছেই

ধান-চাল উৎপাদনের প্রধান জেলাগুলোতে এখন ব্যাংক ঋণের ছড়াছড়ি চলছে। ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতা করে কৃষক পর্যায় পর্যন্ত ঋণ বিতরণে মেতে উঠেছে। মূলত এই ব্যাংক ঋণের কল্যাণে শুরু হয়েছে ধানের নতুন এক ধরনের মজুদদারি। আর এতেই বেড়ে যাচ্ছে চালের দাম।

জেলাপর্যায়ে ও রাজধানীর চালের আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চালের দাম বাড়ার মূল কারণ হাটবাজারে ধানের দাম বেশি। মজুদদারি, ধান কেনার জন্য মিলগুলোর প্রতিযোগিতা এবং ব্যাংকের দেওয়া ঋণ ধানের দাম বাড়ানোর পেছনে ভূমিকা রেখেছে। ব্যাংক ঋণ ও ক্ষুদ্রঋণ ছোট কৃষকদেরও টাকার চাহিদা পূরণ করছে। ফলে আরো দাম বাড়ার আশায় তাঁরাও ধান বিক্রি করছেন না। তবে তাঁদের মজুদ তুলনামূলক খুবই কম। মূলত মিল মালিক, চাতাল মালিক, ফড়িয়া, ব্যবসায়ী ও বড় কৃষকদের ধান মজুদ প্রবণতার কারণেই এই ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পরিশোধের সময়সীমা কমিয়ে দিয়েও এ ক্ষেত্রে সুফল পাচ্ছে না। কারণ এক ব্যাংকের ঋণ শোধের সময় হলে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মজুদদাররা টাকার চাহিদা পূরণ করছেন। আর ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে ঋণ খুবই সহজলভ্য হয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, মিলের সম্পত্তির দামের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ফলে ধানের বাজারদর অনেক বেশি পড়ছে। বেশি দামের ধান থেকে তৈরি চাল আরো কয়েক দফা হাতবদল হয়ে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে অনেক বেশি দামে।
উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রচুর চালকল গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমন মৌসুমে জেলাগুলোতে মোট ধানের উৎপাদন মিলগুলোর চাহিদার তুলনায় কম। মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মিল চালু রাখতে ধানের মজুদ করেন মালিকরা। এ জন্য তাঁরা অন্যের চেয়ে বেশি দামে হলেও ধান কিনতে চান। এতেও চালের দাম বাড়ে।
এসব বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহমেদ হোসেন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চালের দাম বাড়ার একটা কারণ হতে পারে মিলারদের কারসাজি। তাঁরা ধান কিনে মজুদ করে রাখছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাঁরা বিপুল পরিমাণ ধান কিনছেন। এ ধান বাজারে না ছাড়া হলে স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়বে।’
আহমেদ হোসেন খান বলেন, ‘ধান-চালের দাম বাড়ার সুফল কৃষকও পাচ্ছেন। এখন কৃষকরা অনেক সচ্ছল। তাঁরা দাম না বাড়লে ধান বিক্রি করছেন না।’
দুই মাস ধরে বাড়ছে দাম : গতকাল শনিবার রাজধানীর কাজীপাড়া বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৩৬ টাকা দরে। কারওয়ান বাজারে চালের সর্বনিু দাম রাখা হচ্ছে ৩৫ টাকা। আর বাবুবাজার-বাদমতলীর আড়তে প্রতি কেজি মোটা চালের পাইকারি দর ৩৩-৩৪ টাকা। উত্তরাঞ্চলে মোটা চালের ধানের দাম মণপ্রতি ৮০০-৮৫০ টাকা। মৌসুমের শুরুতেই এ দাম ১০০-১৫০ টাকা বেড়ে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
কারওয়ান বাজারের লাকসাম ট্রেডার্সের বিক্রেতা আমান উল্লাহ জানান, প্রতি সপ্তাহেই কমবেশি হারে চালের দাম বাড়ছে। এমনকি সকালে একদরে বিক্রি হলে বিকেলেই তা বেড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বাজারে এ অবস্থা চলছে। তিনি বলেন, ‘ক্রেতা এলে আমাদের খুব খারাপ লাগে। কারণ তাদের কথা দিয়ে কথা রাখতে পারি না। সকাল-বিকেল দাম বেড়ে যায়।’
বাবুবাজারের শিল্পী রাইস এজেন্সির বিক্রেতা কাওসার হোসেন বলেন, দুই মাস ধরে প্রায় প্রতিদিন চালের দাম মণপ্রতি ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা করে বাড়ছে। এভাবে দুই মাসে মণপ্রতি বেড়েছে প্রায় ২০০ টাকা।
ঢাকার বাইরে নওগাঁয় গতকাল খুচরা বাজারে মোটা চাল ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা এবং চিকন জিরা শাইল ও নাজির ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। শেরপুরে পাইকারি বাজারে মোটা চাল ৩১.৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
অন্য রকম মজুদদারি : ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এর পেছনে চাতালমালিক, মিলমালিক, ফড়িয়া ও বড় কৃষকদের মজুদ প্রবণতাই দায়ী। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাঁরা বিপুল পরিমাণ ধান মজুদ করেছেন। বাজারে সরবরাহের চেয়ে ক্রেতা বেশি হয়ে যাওয়ায় দাম বেড়ে গেছে। আর কৃষকরা লাভের আশায় কিছু কিছু ধান ধরে রাখছেন। এর সুফলও তাঁরা পাচ্ছেন।
দিনাজপুর চালকল মালিক গ্র“পের সাধারণ সম্পাদক শহীদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন কালের কণ্ঠকে জানান, অটোমিলগুলো ব্যাংক থেকে দু-তিন কোটি টাকা করে প্লেস লোন নিয়েছে। অন্য মিলগুলোর ঋণ আছে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা করে।
দিনাজপুরের বাহাদুর বাজারের পাইকারি চাল বিক্রেতা গোলাম মোস্তফা কালের কণ্ঠকে জানান, ঋণের টাকায় ধান মিলে মিলাররা গড়ে তুলেছেন বিশাল মজুদ। স্থানীয় পাইকারি বিক্রেতাদের হাতে তেমন চাল নেই। যত চাল ছাঁটাই হয়, তার বেশির ভাগের ক্রেতা জেলার বাইরের ব্যবসায়ীরা। আগাম টাকা দিয়ে ধান কিনে তাঁরা ইচ্ছেমতো চাল ছাঁটাই করে বাজারে ছাড়েন। এ জন্য স্থানীয় অটোমিলগুলোর অধিকাংশের নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে। মিলারের ঘরে মজুদ দেখা গেলেও এসবের মালিক বাইরের ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেট চাইলে বাজারে চাল ওঠে। দাম বাড়ে পাইকারি এবং খুচরা বাজারে। আলোচনার বাইরে রয়ে যায় ব্যাংকের প্লেস লোন এবং মজুদদার ব্যবসায়ীদের ভূমিকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী জানান, দিনাজপুর শিল্প কারখানায় উন্নত নয়। অথচ গত কয়েক মাসে জেলা শহরে শাখা খুলে বসেছে প্রায় এক ডজন বেসরকারি ব্যাংক। মূলত চালকলভিত্তিক সেক্টরে মৌসুমি বিনিয়োগ থেকে লাভের আশায় ব্যাংকের শাখা খোলার হিড়িক চলছে দিনাজপুরে।
নওগাঁ পৌর চাল বাজারের ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী রিংকু সাহা জানান, নওগাঁর প্রতিটি মিলেই কিছু না কিছু চাল মজুদ থাকেই। এর পরিমাণও বিপুল। ওই মজুদ যদি বের করে আনা যায়, তবে চালের দাম অনেকটাই কমে যাবে।
একই এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘মিলমালিকদের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতায় নেমেছে। একই সম্পত্তির ওপর এক ব্যাংক যে পরিমাণ ঋণ দেয়, আরেকটি ব্যাংক প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে সেই ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। উদ্বৃত্ত ঋণের টাকা দিয়ে ব্যবসায়ীরা সহজলভ্য হিসেবে ধান-চাল মজুদ করছেন। এতে বেড়ে যাচ্ছে চালের বাজার।
ঢাকার বাবুবাজারের চাল ব্যবসায়ী কাওসার হোসেন বলেন, ‘বাস্তবতা হলো ধানের মজুদ এখন ফড়িয়া ও মিলমালিকদের দখলে। তাঁরাই দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। বাজারে চালের কোনো ঘাটতি নেই যে ওই কারণে দাম বাড়বে।’
শেরপুর জেলা রাইস মিলমালিক সমিতির সভাপতি আশরাফুল আলম তালুকদার সেলিম বলেন, এখন মিলের সংখ্যা অনেক বেশি। সবাই বাজারে ধান কিনতে যায়। কিন্তু দেখা যায়, বাজারে ২৫ জনের ধান আছে, ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৫০ জন। স্বভাবতই প্রতিযোগিতার কারণে ধানের দাম বাড়ছে। আর উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে চালের দামও বাড়ছে। তিনি জানান, অনেক মিল মালিক এবং ধান-চাল ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা এখন ধান কিনে রাখছেন, তিন চার মাস পর চাল করে বিক্রি করবেন। তা ছাড়া কৃষকরাও এখন সচেতন। তাঁরা যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ধান বিক্রি করে বাকি ধান গোলায় ধরে রাখছেন। এসব কারণেই মূলত চালের দাম বাড়ছে।
ঋণের টাকায় ধান-চাল মজুদ ঠেকাতে গত ২৯ ডিসেম্বর ঋণ পরিশোধের সময়সীমা কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিন এক সার্কুলারে ধান, চাল বা চাতাল ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সীমা কমিয়ে ৩০ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে মিলমালিকদের ক্ষেত্রে এ ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৪৫ দিন এবং ধান বা চাল ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০ দিন ছিল।
---
রাজীব আহমেদ (ঢাকা), সালাহ উদ্দিন আহমেদ (দিনাজপুর), ফরিদুল করিম (নওগাঁ) ও হাকিম বাবুল (শেরপুর)
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger