তারল্য সংকট, বিক্রির চাপ: ফের শেয়ারের দরপতন

রপতন দিয়ে সপ্তাহ শেষ হয়েছিল বৃহস্পতিবার। সেই ধারা থেকে বেরোতে পারেনি গতকাল রবিবারের শেয়ারবাজার। বাজার বিশ্লেষকদের ধারণা, গত সোম ও মঙ্গলবার দরপতনের সুযোগ নিয়ে যেসব বিনিয়োগকারী (প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ) শেয়ার কিনেছিলেন, গতকাল তাঁদের অনেকেই লাভ উঠিয়ে নিয়েছেন।

বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে অতিমাত্রায় শেয়ার বিক্রির কারণে অল্প সময়ের ব্যবধানে গতকাল অধিকাংশ কম্পানির শেয়ারের দরপতন ঘটে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। এদিকে বর্ধিত মার্জিন ঋণ প্রদানে গতকালও বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর ছিল অনীহা। ফলে বিক্রি আর ক্রয়ের মধ্যে ভারসাম্য থাকেনি। ঘটে দরপতন।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এখনো বিনিয়োগকারীদের মন থেকে আতঙ্ক দূর হয়নি। তিনি বলেন, সরকারের চাপে বাজারের পতন ঠেকাতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনেছিল। এখন হয়তো সেগুলো বিক্রি করে দিচ্ছে। এ কারণে গতকাল বিক্রির চাপ ছিল বেশি। এ ছাড়া মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের কারণে ঋণ দিতে পারছে না। এসব ঘটনা বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই গতকাল শুরু থেকে বিক্রির চাপ বেড়ে যায়। ফলে দরপতন শুরু হয়। এ পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মনে আগের সপ্তাহের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন শুরু হওয়ার মাত্র ৪৫ মিনিটের মধ্যে আগের দিনের তুলনায় সূচক ২০০ পয়েন্ট কমে ৭৩৭৫ পয়েন্টে নামে। এ সময় সাতটি কম্পানি বাদে লেনদেন হওয়া বাকি ২৪০টি কম্পানির শেয়ারের দাম কমে যায়। এর আধঘণ্টায় সূচক আবার ৯০ পয়েন্ট বেড়ে ৭৪৬৫ পয়েন্টে ওঠে। কিছুক্ষণ পর আবার নামতে থাকে সূচক। দুপুর পৌনে ২টার দিকে ৩১২ পয়েন্ট কমে সূচক ৭২৬৩ পয়েন্টে নামে।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) লেনদেন হওয়া ১৮৪টি কম্পানির শেয়ারের মধ্যে কমে ১৬৯টির, বেড়েছে মাত্র ১৩টির। অপরিবর্তিত ছিল দুটি কম্পানির শেয়ারের দাম।
গতকাল পতনের শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার ও সদস্য ইয়াসিন আলীসহ অন্য কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন চেহারায় সার্ভিল্যান্স রুমে বারবার ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। এ সময় কমিশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে শেয়ারবাজারে অর্থপ্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা চালানো হয়। এ ছাড়া বিক্রির হার কমিয়ে শেয়ার কেনার চাপ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানানো হয়।
সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় পুঁজিবাজারে অস্থিরতা সামাল দিতে একপর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও তৎপর ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) তাৎক্ষণিকভাবে ২০০ কোটি টাকা তহবিল ঋণ দেওয়া হয়। এ তহবিল ব্যবহার করে দিনের লেনদেনের মাঝামাঝি সময়ে আইসিবি শেয়ার কিনতে শুরু করে। এ কারণে দুপুর ২টার দিকে শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়। পৌনে ২টা থেকে অধিকাংশ শেয়ারের হারানো দর পুনরুদ্ধার শুরু হয়। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতের দর বৃদ্ধির মাত্রা ছিল অন্যান্য খাতের তুলনায় বেশি। একই সঙ্গে বীমাসহ মৌল ভিত্তিসম্পন্ন বেশ কিছু কম্পানির শেয়ারের হারানো দর কিছুটা পুনরুদ্ধার হলে সূচক বড় ধরনের পতনের হাত থেকে রক্ষা পায়। দিনের লেনদেন শেষে ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের চেয়ে ১৪১ পয়েন্ট কমে দাঁড়ায় ৭৪৩৪ পয়েন্টে।
গতকাল ডিএসইতে ২৪৭টি কম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আট কোটি ৬৯ লাখ ৫৮ হাজার ৮৪৫টি শেয়ার ও ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল এক হাজার ১৬৬ কোটি ৬১ লাখ ৮৭ হাজার ৫১ টাকা। এটা আগের দিনের চেয়ে ১০৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা বেশি। শেষ পর্যন্ত লেনদেনকৃত ২৪৭টি কম্পানির মধ্যে দাম কমেছে ২১৫টি কম্পানির শেয়ার। বেড়েছে ৩২টির।
গতকালের বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ২২ হাজার ৭৮৪ কোটি ২৭ লাখ ৩১ হাজার ২৯৬ টাকা।
এদিকে এসইসির পক্ষ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হলেও পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট কাটছে না। প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে না পেরে অধিকাংশ মার্চেন্ট ব্যাংকই মার্জিন ঋণের হার বাড়াতে পারেনি। গত এক মাসের মধ্যে মার্জিন ঋণের হার ১ঃ০.৫ থেকে তিন দফায় বাড়িয়ে ১ঃ২ করা হয়েছে। এ ছাড়া মার্জিন নির্ধারণের ক্ষেত্রে শেয়ারের প্রকৃত সম্পদ মূল্যভিত্তিক (এনএভি) হিসাব পদ্ধতির কার্যকারিতা স্থগিত করা হয়েছে। ওই পদ্ধতি কার্যকর থাকায় গত ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মার্জিন ঋণের প্রকৃত হার ছিল ১ঃ০.২৫। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে মার্জিন ঋণের হার প্রায় আট গুণ বেড়ে যাওয়ায় সে অনুযায়ী তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বর্ধিত হারে ঋণ দিতে পারছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অর্থ সংকটের কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানই এখন পর্যন্ত এসইসির ঘোষণা অনুযায়ী বর্ধিত হারে ঋণ দিতে পারেনি। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ১ঃ০.৭৫ থেকে ১ঃ১ হারে ঋণ প্রদান করছে।
মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি নির্দেশনার কারণে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত ১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের মাস্টার সার্কুলারে ব্যাংকগুলোকে তাদের সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউসকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে একক গ্রাহক ঋণসীমা মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়। একক গ্রাহক সীমা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে তার মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না।
এর আগে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিজস্ব বিভাগ বা ইউনিট হিসেবে কাজ করায় তাদের দেওয়া মার্জিন ঋণ ব্যাংকের নিজস্ব বিনিয়োগ হিসাবে ধরা হতো। ফলে এ ক্ষেত্রে ঋণের কোনো সীমা নির্ধারিত ছিল না। কিন্তু মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো সাবসিডিয়ারি কম্পানি হয়ে যাওয়ায় মার্জিন ঋণ দেওয়ার জন্য তাদের ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়। সে ক্ষেত্রে আলাদা কম্পানি হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠানও তাদের মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারে না। পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ বিধানের প্রয়োগ শিথিল করার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো তাদের মূল ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নিতে পারছে না। এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠান মার্জিন ঋণের হার বাড়াতে পারছে না।
এদিকে ডিএসইর লেনদেন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিএসইর সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজ সবচেয়ে বেশি শেয়ার বিক্রি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি সর্বমোট ৯৪ কোটি ৮৩ লাখ ৫৭ হাজার ৮৬৮ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে লঙ্কাবাংলার কেনা শেয়ারের মূল্য ছিল ৭৩ কোটি ২৩ লাখ ৬৪ হাজার ১৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি শেয়ার ক্রয়ের তুলনায় বিক্রির পরিমাণ ছিল ২১ কোটি ৫৯ লাখ ৯৩ হাজার ৮৫০ টাকা বেশি। বিক্রির পরিমাণের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আল আরাফা ব্যাংক ৩৬ কোটি ১৭ লাখ ৬৩ হাজার ৬৯০ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। কিনেছে ১৯ কোটি ১০ লাখ ১৩ হাজার ৪২৪ টাকার শেয়ার। এ প্রতিষ্ঠানের নিট বিক্রির পরিমাণ ১৭ কোটি সাত লাখ ৫০ হাজার ২৬৬ টাকা বেশি। এ ছাড়া পিএফআই সিকিউরিটিজ ২৬ কোটি টাকা, আইআইডিএফসি সিকিউরিটিজ ২৬ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ২৩ কোটি, ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ড ২৮ কোটি, আইডিএলসি ২১ কোটি, ফখরুল ইসলাম সিকিউরিটিজ ২৩ কোটি, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ২৩ কোটি এবং ওইফ্যাং সিকিউরিটিজ ২৬ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার পরিমাণ ছিল অনেক কম।
এ ছাড়া শাহজালাল ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, এসইএস সিকিউরিটিজ, এনসিসি ব্যাংক, সিএমএসএল সিকিউরিটিজ, এসসিএল সিকিউরিটিজ, ন্যাশনাল ব্যাংক, রয়েল ক্যাপিটাল, ঢাকা ব্যাংক এবং হ্যাক সিকিউরিটিজে শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ছিল কেনার তুলনায় অনেক বেশি।
অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি সিকিউরিটিজ এককভাবেই শেয়ার কিনেছে ২২৯ কোটি ৩৫ লাখ ৬৮ হাজার ২৩০ টাকার। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ২৭ কোটি ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার ছয় টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। কেনার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ব্র্যাক ইপিএল। এই প্রতিষ্ঠান ২৪ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে। এর বিপরীতে বিক্রি করেছে ১২ কোটি টাকার শেয়ার। এ ছাড়া কেনার দিক থেকে শীর্ষ তালিকায় ছিল বিএলআই সিকিউরিটিজ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মাল্টি সিকিউরিটিজ, এসএআর সিকিউরিটিজ, এবি সিকিউরিটিজ, সিনহা সিকিউরিটিজ, শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেড ও সুইফট ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger