কোলন ক্যান্সারঃ সতর্ক থাকুন by ডা. সাবরিনা শারমিন

বিশ্বজুড়ে যত রোগী ক্যান্সার আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে আক্রান্তের হিসাবে তৃতীয় বৃহত্তম হলো কোলোরেক্টাল ক্যান্সার। কোলোরেক্টাল ক্যান্সার বলতে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার বোঝায় সিকাম, এসেন্ডিং কোলন, ট্রান্সভার্স কোলন, ডিসেন্ডিং কোলন, রেক্টাম ও এপেন্ডিঙ্-এর ক্যান্সার।

কোলন ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হন উন্নত বিশ্বের বাসিন্দারা। রোগীর দুই-তৃতীয়াংশই উন্নত বিশ্বের। তার পরও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ সালে গ্লোবোক্যান (ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান) এর হিসাব অনুসারে ২০ লাখ লোক কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ও প্রতিবছর ছয় লাখ লোক এই রোগে মৃত্যুবরণ করে।

লক্ষণ
বৃহদান্ত্রের কোনো অংশ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে আর তা কতদূর বিস্তার লাভ করেছে তার ওপর রোগের লক্ষণগুলো নির্ভর করে। গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণগুলো হলো_
পায়ুপথে রক্তক্ষরণ : কখনো পরিমাণে বেশি হতে পারে আবার কখনো সামান্যও হতে পারে। এটি গাঢ় লাল তাজা রক্ত হতে পারে আবার পুঁজমিশ্রিত কালচে লাল রক্তও হতে পারে। কখনো পায়খানা কালো হতে পারে।
* মলত্যাগের প্রাত্যহিক অভ্যাসের পরিবর্তন অর্থাৎ কখনো ডায়রিয়া বা কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।
* মলত্যাগ অসম্পূর্ণ_এমন অনুভূতি হয়। এ কারণে রোগী বারবার টয়লেটে গিয়ে মলত্যাগের চেষ্টা করে।
* পেটে চাকা অনুভূত হয়। এ ক্ষেত্রে রোগী হঠাৎ করেই পেটে চাকা টের পায়।
* পেটে বা পায়ুপথে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
* কোলনের মল সঞ্চালন বন্ধ হয়ে (কখনো ক্যান্সার অনেক বড় হয়ে এমনটি হতে পারে) পায়খানা আটকে যায়। ফলে পেট ফুলে যায়, পেটে ব্যথা হয় ও বমি হতে পারে।
* কখনো রোগীর অন্য কোনো অসুবিধা থাকে না শুধু রক্তশূন্যতা হয়। সাধারণত ডানদিকের কোলন অর্থাৎ সিকাম বা এসেন্ডিং কোলনের ক্যান্সারে রোগী শুধু রক্তশূন্যতা ও দুর্বলতা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসে।
* বামদিকের বড় টিউমার হলে অনেক সময় তা বাম দিকের মূত্রনালিকে চেপে রাখে ফলে বামদিকের কিডনি ফুলে যায়। যা হাইপোনেফ্রসিস নামে পরিচিত।
* রোগীর ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, রুচি কমে যায়।
মনে রাখতে হবে, লক্ষণ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে রোগীর চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয় ও ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর আশঙ্কা অনেক কমে যায়। রোগ যদি একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় থাকে অর্থাৎ টিএনএম স্টেজ এক ও দুই থাকে_ সেক্ষেত্রে ক্যান্সার শুধু বৃহদান্ত্রের দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তখন চিকিৎসা করলে ৯০ শতাংশ রোগী পাঁচ বছরের বেশি বেঁচে থাকে। কিন্তু যদি টিএনএম স্টেজ তিন অর্থাৎ বৃহদান্ত্রের বাইরের চারপাশে ও লিম্ফনোডে ছড়ায় সে ক্ষেত্রে সব ধরনের চিকিৎসা করা হলেও (এমনকি উন্নত বিশ্বেও) মাত্র ৪০ শতাংশ রোগী পাঁচ বছর পর্যন্ত বাঁচে। আর কোলন ক্যান্সার যদি স্টেজ চার-এ অর্থাৎ কোলন থেকে দূরবর্তী স্থানেও ছড়ায় সে ক্ষেত্রে সব ধরনের আধুনিক চিকিৎসা সত্ত্বেও মাত্র ৫-৭ শতাংশ রোগী সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কাজেই সংকোচ, দ্বিধা ইত্যাদি বশবর্তী হয়ে কখনোই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে দেরি করবেন না।

কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কাদের বেশি?
কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত কারা হবেন তা আগে থেকে বলা কঠিন। তবে কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
বয়স
যদিও অল্প বয়সেও কোলন ক্যান্সার হওয়া সম্ভব তার পরও বেশি বয়সে যেমন ৫০ বছরের পর কোলন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে থাকে। প্রতিবছর কোলন ক্যান্সারে যে পরিমাণ রোগী আক্রান্ত হয় এর মধ্যে শতকরা ৯০ জনের বয়সই ৫০-এর বেশি। তাই এ বয়সে যদি হঠাৎ মলত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন হয়, পায়ুপথে রক্ত যায় অথবা অকারণেই রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে রক্তের অকাল ব্লাড টেস্ট ও কোলনস্কোপি করা উচিত।
লিঙ্গ
যদিও কোলোরেক্টাল ক্যান্সারে নারী-পুরুষ উভয়েরই সমভাবে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, তবে আমেরিকান সোসাইটি ফর ক্যান্সার রিসার্চের তথ্য অনুসারে নারীরা কোলন ক্যান্সার ও পুরুষরা রেক্টাল ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হয়।
বংশগত
নিকট আত্মীয়, যেমন মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। একের অধিক নিকটাত্মীয় এ ধরনের সমস্যার শিকার হলে কোলন ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা আরো অনেক বেশি থাকে। বংশগত কোলন ক্যান্সার আবার দুই রকম হতে পারে।
হেরেডিটারি ননপলিপসিস কোলন ক্যান্সার : এ ক্ষেত্রে এইচএনপিসিই জিনের পরিবর্তনের কারণে কোলন ক্যান্সার হয়ে থাকে। শতকরা ৩-৫ শতাংশ কোলন ক্যান্সার এ কারণে হয়। সাধারণত ৪৪-৪৬ বছর বয়সে ধরা পড়ে। বংশে কারো থাকলে অথবা পরপর দুই জেনারেশন অথবা দুই বা এর অধিক আত্মীয় আক্রান্ত হলে কোলন ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। তাই আপনার বংশে এমন থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন ও নিশ্চিত হোন।
ফ্যামিলিয়াল এডিনোমেটাস পলিপসিস : এ ক্ষেত্রে এপিসি জিনের মিউটেশনের কারণে ক্যান্সার হয়। ১-২ শতাংশ কোলন ক্যান্সার এ কারণে হয়। এ ক্ষেত্রে রেক্টাল ও কোলনে শতাধিক পলিপ থাকে। বয়োসন্ধিতেই এসব পলিপ পাওয়া যায় ও ২০-৩০ বছর বয়সের মধ্যেই তা ক্যান্সারে রূপ নেয়। কাজেই কারো বংশে এ ধরনের ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে অথবা অল্প বয়সে কোলন ক্যান্সারের ঘটনা থাকলে ১০-১২ বছর বয়সেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সার্জারি করে নিন।
খাদ্যাভ্যাস
যাঁরা মাংস, বিশেষ করে গরু ও খাসির মাংস বেশি খান ও আঁশসমৃদ্ধ খাবার কম খান তাঁদের মধ্যে কোলন ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। আঁশসমৃদ্ধ খাবার বৃহদান্ত্রের সঞ্চালন বা পেরিস্টালসিসকে দ্রুততর করে ফলে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদানগুলো কোলনের সংস্পর্শে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ফলে কোলন ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কাও কমে। তৈলাক্ত খাবার, টিনজাত খাবার ও ফাস্টফুডও ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণেই উন্নত বিশ্বে কোলন ক্যান্সার হওয়ার হার বেশি। তাই মাংস ও
ফাস্টফুড কমিয়ে দিয়ে মাছ, সবজি ইত্যাদি বেশি করে খান।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিক রোগীদের কোলন ক্যান্সারে ভোগার আশঙ্কা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। তাই রক্তের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
বৃহদান্ত্রের অন্য সমস্যা
কারো যদি কোলনে এডেনোমা বা পলিপ থাকে তা বর্তমানে ক্যান্সার নয়, সেখান থেকেও ক্যান্সার হতে পারে। তাই প্রথম অবস্থায়ই সতর্ক হন। কারো যদি ইনফ্ল্যামেটরি বাউল ডিজিজ যেমন আলসারেটিভ কোলাইটিস থাকে, সেখান থেকেও ক্যান্সার হতে পারে। তাই যাদের দীর্ঘদিন ধরে প্রায়ই রক্তমিশ্রিত পায়খানা হয়, পেটে ব্যথা হয়, ডায়রিয়া হয় তাঁরা পরীক্ষা করিয়ে নিন।
ধূমপান
ধূমপান কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। সিগারেটের ক্ষতিকারক পদার্থ মুখের লালার মধ্যে দ্রবীভূত হয়ে পেটে যায় ও ক্যান্সার তৈরি করতে পারে।
মদ্যপান
যাঁরা বেশি মদ্যপান করেন তাঁদের কোলন ক্যান্সার বেশি হয়। অতিরিক্ত মদ্যপান শরীরের ফলিক এসিডের পরিমাণ কমিয়ে দেয় যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
মেদ বা অতিরিক্ত ওজন
কায়িক পরিশ্রমের অভাব ও শরীরচর্চায় অনাগ্রহ, অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদিও কোলন ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
শরীরের অন্যান্য অংশের ক্যান্সার
শরীরের অন্যান্য অংশ যেমন মহিলাদের এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার বা ওভারিয়ান ক্যান্সার থাকলে বা পুরুষদের প্রস্টেট ক্যান্সারের জন্য রেডিও থেরাপি নিলেও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
তবে মনে রাখতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র ছাড়া ক্যান্সার হবে না বা দুই-তিনটা ঝুঁকির কারণ থাকলেই ক্যান্সার হবে_এমন কোনো কথা নেই।

চিকিৎসা
কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে এটি কোন স্টেজে আছে তার ওপর। কোলন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অপারেশনই কার্যকরী চিকিৎসা। তবে কখনো বাইপাস বা প্যালিয়েটিভ বা ফিকাল ডাইভারশনের কারণেও সার্জারিও করা হয়। অপারেশনের আগে বা পরে অথবা উভয় ক্ষেত্রেই কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়।
কোলন ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

দেশে কোলন ক্যান্সার কেন ভয়ের কারণ

* আমাদের দেশে পায়ুপথের সমস্যা যেমন পায়ুপথে রক্তক্ষরণ, পায়ুপথে কোনো বৃদ্ধি বা গ্রোথ ইত্যাদি হলে প্রায় সবাই এটিকে গোপন রাখতে চায়। ফলে সংকোচ, লজ্জা ও দ্বিধায় থেকে পরিবারের কাউকে এটি সে জানায় না, চিকিৎসাও করে না।
* পায়ুপথে যেকোনো সমস্যা হলেই পাইলস বলে মনে করে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে 'অর্শ ভগন্দর পাইলস' ইত্যাদি কবিরাজি চিকিৎসালয়ের শরণাপন্ন হয়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে অর্থ, সময় ইত্যাদি নষ্ট করে।
* বাংলাদেশে কোলন ক্যান্সারের জন্য কোনো রুটিন চেকআপ করা হয় না। বংশে কারো কোলন ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলেও অনেকে এ ব্যাপারে মোটেই সচেতন নন। আবার দেশের অনেক স্থানেই এখনো কোলনস্কোপি ও জেনেটিক টেস্টের সুবিধা নেই।
* বাংলাদেশে ধূমপান, তামাক, বিড়ি ইত্যাদি সেবনকারী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, যা কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ক্যান্সার বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোফাজ্জল হোসেন (অব.)-এর মতে, বাংলাদেশে সর্বাপেক্ষা বেশি সংঘটিত পাঁচটি ক্যান্সারের একটি হলো কোলোরেক্টাল ক্যান্সার এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, দেশে রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে আসে ও কোলন ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত হয়, তখন ইতিমধ্যেই তা জটিলতা ধারণ করেছে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই সুচিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না।

প্রতিরোধ

* ধূমপান পরিহার করুন।
* ওজন কমান।
* গরু ও খাসির মাংস কম খান।
* মাছ বেশি খান।
* শাকসবজি ও ফল বেশি খান।
* ভিটামিন ডি ও ফলিক এসিড খান।
* ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
* কোনো সমস্যা হলে দ্রুত ব্যবস্থা নিন।
* অপচিকিৎসা বর্জন করুন।
* বংশে কোলন ক্যান্সার হওয়ার ঘটনা থাকলে আগেই ব্যবস্থা নিন।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger