লাল গোলাপের দেশে by সোনিয়া ইসলাম

চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধতা। বসন্তের মিষ্টি রোদে ধানের সবুজ কচি শিষে আলোর ঝিকিমিকি। ধানখেতের আল ধরে হাঁটলাম দীর্ঘপথ। তারপর উঁচু রাস্তা। লাল মাটির মেঠোপথ। যেন হেঁটে চলেছি আবহমান গ্রামবাংলার ছবির ভেতর দিয়ে।
মেঠোপথ পেরোলেই গোলাপের দেশ। শুনতে বহুদূরের পথ মনে হলেও ওই গোলাপের দেশ কিন্তু রাজধানীর খুব কাছেই। বুকে লাল ফুলের বন্যা নিয়ে তুরাগ নদের কোলে এক সবুজ দ্বীপ যেন ঢাকার সাভারের বিরুলিয়া গ্রাম।

প্রিয়ার কাছে পৌঁছানোর তাড়া তো থাকেই। কিন্তু অনেক সময় পথও তো হয়ে ওঠে রোমাঞ্চকর! আর গোলাপ! সে তো ফুলের রানি। তাকে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়। অনেকটা পথ হেঁটে হেঁটেও যখন তার হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন মনে হলো গোলাপদেবী বুঝি অভিমানই করেছেন। যাহোক, ১১টা নাগাদ প্রথম বাগান দেখেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। সেই শুরু। তারপর শুধু গোলাপ আর গোলাপ। মাঠের পর মাঠের বদলে এ হলো গোলাপের বনের পর বন।

প্রথমে ভেবেছিলাম কেবল বিরুলিয়া গ্রামেই বুঝি গোলাপের চাষ হয়। কিন্তু শুধু বিরুলিয়া নয়, সারুলিয়া, ভাগ্নিবাড়ি, সাদুল্লাপুর, শ্যামপুরসহ আশপাশের সব গ্রামেই কমবেশি গোলাপের চাষ হয়। দুপুর হয়ে যাওয়ায় ফুটন্ত গোলাপ খুব একটা চোখে পড়েনি। বিকেল নাগাদ আধফোটা ফুলগুলো ফুটে যায়। তাই বিকেলেই ফুল তোলা হয়। গোছা গোছা করে বেঁধে প্রস্তুত করা হয় হাটে নিয়ে যাওয়ার।

গোলাপের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তখন পড়ন্ত দুপুর। এমনিতেই গ্রামগুলো শান্ত। তার ওপর দুপুরের নিস্তব্ধতায় যেন নিঝুমপুরি। সুন্দর ছবির মতো গ্রামগুলোর সৌন্দর্য অপার্থিব মহিমা ছড়াচ্ছিল আদিগন্ত বিস্তৃত লাল গোলাপের সমাহারে। একে তো গ্রামের রূপ তার সঙ্গে গোলাপের মহিমা—সব মিলিয়ে বিরুলিয়া যেন রূপকথার দেশ।
নিঝুম শান্ত গ্রামগুলোর চারপাশে যতদূর চোখ যায় কেবল গোলাপের বন। ছবি: লেখক

পুরো মাঠে ফুটন্ত লাল গোলাপের চোখ ঝলসানো সৌন্দর্য দেখতে না পারার একটা কষ্ট মনে মনে অনুভব করলেও, যা দেখেছি তার সৌন্দর্যও অসাধারণ। নিঝুম শান্ত গ্রামের আনাচ-কানাচে গোলাপের বন। যতই সামনে এগোচ্ছিলাম মুগ্ধতা বেড়েই চলছিল। ঢাকা শহরের অদূরেই এমন সৌন্দর্যের উত্স দেখে বিস্ময় জাগে।

বিরুলিয়া পৌঁছানোর আরও সোজা পথ আছে। বাসে-রিকশায় চলে যাওয়া যাবে অনেক কাছাকাছিই। ঢাকা থেকে বাসে সাভার বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে মিনিবাসে বিরুলিয়া বাজার। এরপর আপনি চাইলে হেঁটে বা রিকশায়ও চলে যেতে পারেন গ্রামের ভেতরে। তবে, নির্জন সকাল বা দুপুরে রিকশা খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন বৈকি। আর যেতে পারেন ঢাকার মিরপুর-১ থেকে বেড়িবাঁধ হয়ে নদী পার হয়েও। বেড়িবাঁধে রিকশা বা বাস যাতেই থাকুন বলতে হবে বিরুলিয়া যাব। তাহলেই আপনাকে নামিয়ে দেওয়া হবে খেয়াঘাটে। নৌকায় মাত্র চার-পাঁচ মিনিটেই পার হয়ে যাবেন নদী। ওপারেই বিরুলিয়া গ্রাম।

সেখানকার শ্যামপুরে প্রতিদিনই বসে গোলাপের হাট। ফুলচাষিরা ফুল কেটে নিয়ে চলে আসেন এই হাটে। সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় ফুল ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য ব্যবসায়ী এসে ভিড় জমান এখানে। রাতে জমতে থাকে বেচাকেনা। ভোর থাকতে থাকতেই সেই ফুল পৌঁছে যাওয়া চাই রাজধানী ঢাকার শাহবাগে, পৌঁছে যাওয়া চাই এমন সব পাইকারি বিক্রির কেন্দ্রে। সেখান থেকে তা যাবে পাড়া-মহল্লার দোকানে দোকানে। তাই ফুলচাষিরা রাতেই করেন ফুলের বিকিকিনি।

গোলাপের চাহিদা থাকে সব সময়। তাই চাষিরাও সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ উত্সবের দিনগুলোতে চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে দামও। লম্বা ডাঁটা রেখে কেটে নেওয়া গোলাপের বড় একটা গোছায় থাকে প্রায় ৩০০ ফুল। এমন একটা গোলাপ গোছার পাইকারি দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তবে উত্সবের সময় তা বেড়ে চলে যায় হাজার টাকার কাছাকাছি।

গোলাপ চাষে লাভের পাশাপাশি খরচও কম নয়। বিরুলিয়ার গোলাপচাষি শাফিজ উদ্দিন জানান, প্রথমবার এক পাকি (৩০ শতাংশের মতো) জমিতে গোলাপ চাষ করতে খরচ হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। আর সারা বছর ধরে যত্নআত্তি তো আছেই। শীতে পোকা-মাকড়ের প্রকোপ কম থাকলেও গরমে খুব বেশি থাকে। তাই নিয়মিত ওষুধ দিতে হয় তখন।

ফেরার পথে গোলাপের পাশাপাশি চোখে পড়ল বেশ কিছু গ্লাডিওলাসের বাগান। লাল মেঠোপথের একদিকে লাল গোলাপ আর অন্যদিকে সাদা গ্লাডিওলাস। ছবির মতো দৃশ্য। যাঁরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভালোবাসেন, নগরের ব্যস্ততম জীবনযাপন থেকে একটু সময় বের করে ঘুরে আসতে পারেন লাল গোলাপের দেশ বিরুলিয়া ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে। অসাধারণ কিছু নির্মল ভালো লাগা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবেন।

ফেরার সময় যখন লাল গোলাপের দেশ পেছনে ফেলে ক্রমশ নাগরিক জীবনের কাছাকাছি আসছিলাম, কেবলই কবি গুরুর সেই লাইনগুলো মনে পড়ছিল— ‘বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।’
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger