মার্কিন দলিলে ভাষা আন্দোলন- বাঙালির ধূমায়িত অসন্তোষ by মিজানুর রহমান খান

পাঠানেরা ভেবেছে পাঞ্জাবিরা তাদের চেয়ে খাটো। পাঞ্জাবিরা ভেবেছে সিন্ধিরা তাদের চেয়ে খাটো। আর তারা সবাই মিলে ভেবেছে বাঙালিরা সবার চেয়ে খাটো। বাঙালিরা তা বুঝল।
তাদের অসন্তোষ ধূমায়িত হলো। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি করাচি থেকে ওয়াশিংটনে এমনই এক মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস। তবে আট পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটিতে ফুটে উঠেছে একটি সমগ্র প্রেক্ষাপট। দ্বিতীয় সচিব চার্লস ডি উইদার্স এটি পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত অভ্র এম ওয়ারেনের পক্ষে। অনুবাদক এই নথিটির আলোকচিত্র সংগ্রহ করেন যুক্তরাষ্ট্রের
ন্যাশনাল আর্কাইভস থেকে। এর নির্বাচিত অংশের প্রথম কিস্তি ছাপা হলো আজ।

১৯৫২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন প্রাদেশিকতাবাদের বিপজ্জনক ঝুঁকি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তাঁর কথায়, প্রাদেশিকতাবাদ হলো বাইরে থেকে আসা যেকোনো হুমকির মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর। তাঁর এ বিবৃতি ছিল এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের ধারাবাহিকতামাত্র। ২৫ ডিসেম্বর লাহোরে জিন্নাহর জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে এ হুমকির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর ক্রুসেড (যুদ্ধ) ঘোষণা করেন এবং বলেন, ইসলাম সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর দাঁড়ানো। ইসলামের কোনো ভৌগোলিক সীমা নেই। যেকোনো প্রদেশ থেকে যে কেউ আসুক না কেন, তাদের একটাই পরিচয়— পাকিস্তানি।
তাঁর সঙ্গে একই সুরে গলা মিলিয়েছেন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ, কায়েদে আজমের বোন ফাতেমা জিন্নাহ্ এবং বাণিজ্য ও শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের মতো বিশিষ্ট পাকিস্তানিরা। উপরন্তু অধিকাংশ পাকিস্তানি সংবাদপত্রে এ বিপদ সম্পর্কে সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছে। ইসলামই যে ঐক্যের ভিত্তি, তা সব উপলক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পাকিস্তানে প্রাদেশিকতাবাদের লক্ষণসমূহ বেসামরিক, কূটনৈতিক এবং সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রশ্নে সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া প্রদেশগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রাজস্ব বণ্টন নিয়ে কলহ, ভাষার প্রশ্ন নিয়ে গোষ্ঠীপরতন্ত্রতা এবং পৃথক প্রতিনিধিত্বের জন্য উদ্বাস্তুদের দাবি। দুর্ভাগ্যবশত প্রায় সহজাতভাবে পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের পাকিস্তানি ভাবার পরিবর্তে কেউ বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি কিংবা অন্য প্রদেশের নাগরিকের পরিচয় দিচ্ছে। নাগরিকদের মধ্যকার এ অনুভূতি প্রায় জন্মগত। এর পেছনে রয়েছে তাদের দেশভাগপূর্ব সাংবিধানিক পটভূমি এবং মুসলিম লীগের আগের নীতিগুলো।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দেশভাগপূর্ব সংবিধান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। এতে ভারতীয়দের নিজেদের বিষয় নিজেদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণে অধিকতর এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। যদিও ওই আইনে একটি ফেডারেল সরকারের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু মূল বিধানাবলি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। ওই আইনটি ১৯০৯ সালের মার্লে-মিন্টো এবং ১৯১৯ সালের মন্টেগ-চেলমসফোর্ড সংস্কারের নীতির আদলে প্রণীত হয়েছিল। ওই দুটো সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল।
১৯৪০ সালের সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনটি বিখ্যাত। এ প্রস্তাবে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের জন্য নির্দিষ্ট প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত হয়। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘১৯৩৫ সালের আইনে ফেডারেশনের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটা ভারতের অসাধারণ পরিস্থিতি বিবেচনায় সম্পূর্ণরূপে অনুপযুক্ত ও অকার্যকর এবং মুসলিম ভারতের জন্য তা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।’
ওই প্রস্তাবে মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গি লিপিবদ্ধ করা হয় যে একটি কার্যকর সংবিধান প্রণয়ন করতে হলে তাতে অবশ্যই ‘ভৌগোলিকভাবে সন্নিহিত ইউনিটগুলোকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এবং সেসব অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো নিয়ে গঠিত হতে হবে...যেমনটা রয়েছে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে। এসব অঞ্চলকে “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহে” রূপ দিতে হবে। এই রাষ্ট্রসমূহের ইউনিটগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং সার্বভৌম...।’ ১৯৪১ সালে মুসলিম লীগের মাদ্রাজ অধিবেশনেও একই দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে ওই ধারণা আবারও সংশোধিত আকারে উল্লিখিত হয়।
দেশভাগের আগে সরকার এবং মুসলিম লীগের নীতির প্রভাবশালী বিষয়বস্তু ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। তাই প্রাদেশিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের মূল নেতা ছিলেন, তাঁদের পক্ষে নিজেদের একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা সবচেয়ে দুরূহ ছিল। দেশভাগের আগে তাঁরা ছিলেন প্রায় সার্বভৌম। অথচ এখন তাঁদের স্বার্থসমূহ ফেডারেল ইউনিয়নের অধীন হিসেবে মেনে নিতে হবে।
প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্যবোধ সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে পূর্ববঙ্গ প্রদেশে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে তাদের অনেক কিছুই আলাদা। খাদ্য, সংস্কৃতি, ভাষা এবং বর্ণ উল্লেখযোগ্যভাবে স্বাধীন পদক্ষেপ গ্রহণে সংবেদনশীল এবং স্বাধীনচেতা বাঙালিদের মানসিকতায় প্রভাব বিস্তার করে। এটা সত্য যে এ প্রদেশে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৪ শতাংশ বাস করে। করাচি থেকে এর দূরত্ব প্রায় দেড় হাজার মাইল। এবং দুই অংশকে বিভক্ত করে রেখেছে ভারত। তাই কেন্দ্র থেকে একে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
পাকিস্তানে এমনটা দেখা যায় যে পাঠানেরা ভাবে পাঞ্জাবিরা তাদের চেয়ে খাটো। পাঞ্জাবিরা ভাবে সিন্ধিরা তাদের চেয়ে খাটো। আর তারা সবাই মিলে ভাবে বাঙালিরা সবার চেয়ে খাটো। বাঙালিরা তাদের প্রতি এ অপছন্দ বুঝতে পেরেছে এবং তাই তাদের অসন্তোষ ধূমায়িত হলো। বাঙালিদের অনুভূতি হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষা করতে পারছে না। ঐতিহাসিকভাবে বাঙালিদের এ অবিশ্বাসের কিছু ভিত্তি রয়েছে। বিখ্যাত উর্দু কবি আল্লামা ইকবাল দ্বিজাতি তত্ত্বের গোড়ার দিককার অন্যতম প্রবক্তা। ১৯৩০ সালে তিনি যখন মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন, তখন তিনি পাকিস্তানের রূপরেখা দিয়েছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি রাষ্ট্রে মিলিত হবে আফগানিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষ। তাঁর ওই রূপরেখায় বাংলার ঠাঁই হয়নি। যদিও বাংলা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমনকি খোদ মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল ঢাকায়।
যখন দেশভাগ ঘটল তখন দেখা গেল, ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে বাঙালি মুসলিম সদস্যসংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ হিন্দু বেসামরিক কর্মকর্তা ভারতে যোগ দিলেন। ইংরেজ সদস্যদের অনেকেই অবসর নিলেন, ভারত ছাড়লেন। এবং বাঙালিরা লক্ষ করলেন যে প্রদেশের বাইরে থেকে বেসামরিক কর্মকর্তাদের আমদানি করা হয়েছে। সেই থেকে বাঙালিরা নিষ্ঠাভরে নিজেদের ওই কর্মকর্তাদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কারণ, বাঙালির প্রতি ওই কর্মকর্তাদের মনোভাব তাঁদের জানা ছিল। নতুন প্রদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে একই পরিস্থিতি বিরাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাঙালি মুসলিম অধ্যাপকদের অভাব দেখা দেয়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের (তখন বাঙালি ভিসি ছিলেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) নেতৃত্বে বাঙালি শিক্ষক এবং প্রদেশের পাঞ্জাবি গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নুনের নেতৃত্বাধীন অবাঙালি শিক্ষকদের মধ্যে তিক্ত লড়াই চলছে। বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে ইউরোপীয় অধ্যাপকদের নিয়োগ করার পক্ষে। এর কারণ স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে ইউরোপীয়দের নিয়োগ দেওয়া যায় এবং তাত্ত্বিকভাবে, প্রশিক্ষিত বাঙালিদের দিয়ে তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ করা যায়। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি অধ্যাপকদের সহজে সরানো যায় না।
পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিকতাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু অসামান্য ঘটনা উল্লেখ করার মতো। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রীদের এক সম্মেলনে এমন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, যাতে বিক্ষোভ দানা বাঁধে এবং তাকে পাশে সরিয়ে রাখতে সচেষ্ট হন খোদ জিন্নাহ। কিন্তু সেটি আবার সামনে চলে আসে এবং কেন্দ্রীয় নীতির সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ভবিষ্যতেও সেটা সামনে আসতেই থাকবে এবং এখন এটি আবার সামনে এসেও গেছে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হিসেবে পর্যায়ক্রমে উর্দুর প্রচলন করা
হবে। এটা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীদের জন্য একটি অশুভ বিষয়।
ছাত্রদের সামনে রেখে প্রাদেশিকতাবাদীদের জন্য বিষয়টি একটি মোক্ষম পরিস্থিতি তৈরি করে। এ নিয়ে বিক্ষোভ ১৯৪৮ সালের গোড়া অবধি চলতে থাকে। জিন্নাহ ঢাকায় ছাত্রদের শান্ত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। জিন্নাহ ব্যক্তিগত আবেদন রেখেছিলেন যে উর্দুই হবে কালক্রমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তিনি এ ছাড় অবশ্য দিয়েছিলেন যে বাংলা হতে পারে প্রাদেশিক ভাষা। জিন্নাহ বাঙালিদের হুঁশিয়ার করে দেন যে প্রাদেশিকতাবাদ হচ্ছে ‘রাষ্ট্রদেহে বিষ সমতুল্য’ এবং এটা পাকিস্তানের জন্য অভিশাপ হতে পারে।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger