বিশ্বায়নের কাল- বাংলাদেশের মতো ব্রিটেন by কামাল আহমেদ

বাংলাদেশের মতো ব্রিটেন। ইংরেজিতে ‘ব্রিটেন অ্যাজ বাংলাদেশ’ শিরোনামটা আমার নয়, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় এবং রক্ষণশীল দৈনিক দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ১৭ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার একটি সংবাদভাষ্যের।
ব্রিটেনের সাম্প্রতিক রেকর্ড সৃষ্টিকারী বন্যা এবং তার দুর্ভোগের ফলে যে জাতীয় বিতর্ক চলছে, তার তুলনা খুঁজতে গিয়ে পত্রিকাটির শিরোনাম রচয়িতার মনে হয়েছে যে এ ক্ষেত্রে একমাত্র তুলনীয় রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ।

ব্রিটেনে যে বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেল, তার ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য কয়েকটি তথ্য এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন। আবহাওয়ার এই বিরূপ ছোবল এক দিন বা কয়েক দিনের নয়, এটি চলেছে প্রায় দুই মাস ধরে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বড়দিনের সময় শুরু হওয়ার পর তা আড়াই মাস ধরে বারবার ফিরে এসেছে। আধুনিককালের কারখানাগুলোতে কনভেয়ার বেল্টে যেভাবে উৎপাদিত পণ্যগুলো আসতে থাকে, সেভাবেই একের পর এক নিম্নচাপ এসেছে। মোট কতবার তা বলা মুশকিল। তবে লন্ডন শহরকে বন্যা বা প্লাবন থেকে রক্ষার জন্য টেমস নদীতে নির্মিত বন্যারোধক বা ফ্লাড ব্যারিয়ারকে এ সময়ে মোট ২৮ বার নামাতে হয়েছে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, এটি নির্মিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যতবার নামাতে হয়েছে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হয়েছে গত দুই মাসে। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর যে বায়ুপ্রবাহের (জেটস্টিম) প্রভাবে এসব বৃষ্টি এবং জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, এই উপর্যুপরি আঘাতের কারণে ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যমে একে ‘কনভেয়ার বেল্ট ওয়েদার ফেনোমেনন’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে।
একটি হিসাবে বলা হয়েছে, ব্রিটেনে যখন থেকে বৃষ্টির হিসাব রাখা শুরু হয়েছে, সেই ১৭৭৬ সালের পর এ বছরই বৃষ্টির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। মাটির পানি শোষণ এবং তা ধরে রাখার ক্ষমতা অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় বন্যার পানি সরে যাওয়ারও কোনো জায়গা ছিল না। ফলে, আবহাওয়া কিছুটা স্বাভাবিক হলেও বন্যার পানি সরতে সময় লাগছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন কবে তাঁদের ঘরবাড়িতে ফিরতে পারবেন, তা এখনো অনিশ্চিত। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। মারা গেছেন অন্তত তিনজন। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কয়েক শ কোটি পাউন্ড ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কারণ থাকবে না। বিমা কোম্পানিগুলো বলছে যে শুধু ঘরবাড়ি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ১০০ কোটি পাউন্ড ছাড়িয়ে যাবে। রেলপথ, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক সপ্তাহ।
তবে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর শিরোনামে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসার কারণ বন্যাপীড়িত ব্রিটিশদের দুর্ভোগের বিষয় নয়, বরং বন্যার দুর্ভোগের কারণটি। বাংলাদেশে বন্যা একটি বার্ষিক অনুষঙ্গ এবং বাংলাদেশিরা বন্যার সঙ্গে নিজেদের জীবনকে খাপ খাইয়ে নেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন বা চেষ্টা করছেন। বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য যে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, বাংলাদেশের জন্য তার সংস্থান করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং, বাংলাদেশে বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাণ ও সম্পদহানি রোধে উঁচু স্থানে আশ্রয়শিবির নির্মাণ, সতর্কবাণী প্রচার, সম্ভাব্য বিপদের সময় বসতবাড়ি ছেড়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করা, স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তুতি—এগুলোর ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্বের পঞ্চম ধনী রাষ্ট্র ব্রিটেনে বন্যার ঝুঁকি মোকাবিলার একটি বড় অংশ হচ্ছে বন্যানিয়ন্ত্রণ।
১৯২৮ সালের বন্যায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ঐতিহাসিক স্থাপনা, ওয়েস্টমিনস্টার ভবন এবং লন্ডনের পাতালরেল প্লাবিত হওয়ার পর লন্ডনকে রক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় এবং সত্তরের দশকে টেমসের ফ্লাড ব্যারিয়ার নির্মাণ শুরু হয়, যা সম্পন্ন হয় ১৯৮২ সালে। এই দ্বীপরাষ্ট্রের উপকূলীয় শহরগুলোর প্রায় সব কটিতেই রয়েছে উঁচু শহর রক্ষাবাঁধ। কোথাও কোথাও তা শত বছরের পুরোনো, কোথাও কোথাও কয়েক দশকের। আবার, কোথাও কোথাও উপকূল থেকে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে বসতি গড়া হয়েছে অনেকটা ভেতরে, যাতে মাঝখানের জায়গাটি পানি ধরে রাখতে পারে। নদীগুলোর নাব্যতা বজায় রাখার জন্যও সময়ে সময়ে ড্রেজিং বা পলি অপসারণের কাজটাও করা হয়। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর বিশেষ করে সমারসেট এলাকার নদীগুলোতে কোনো ড্রেজিং হয়নি। ২০০৭ সালে ওই এলাকায় যে বড় ধরনের বন্যা হয়েছিল, সেই বন্যার পর ড্রেজিংয়ের জন্য দাবি উঠলেও সরকার তার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ দিতে পারেনি। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং পরবর্তী সময়ে টোরি পার্টির কৃচ্ছ্র কর্মসূচি তার অন্যতম কারণ। আর, বন্যানিয়ন্ত্রণে অক্ষমতার মধ্যেই বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রিটেনের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
অবশ্য বলে রাখা ভালো, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর উদ্দেশ্যটা এ ক্ষেত্রে মহৎ নয়, বরং তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাববিষয়ক বিতর্ককে আড়াল এবং নাকচ করার উদ্দেশ্যেই বিষয়টিকে এভাবে তুলে ধরেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টিকারী রক্ষণশীল গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। বৈশ্বিক পরিসরে মিডিয়া মোগল হিসেবে খ্যাত রুপার্ট মারডকের মালিকানায় থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এ বিষয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর মতোই। ব্রিটেনের এই সাম্প্রতিক বন্যার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন এবং বিরোধী নেতা এড মিলিব্যান্ডের প্রায় অভিন্ন অবস্থানকে পত্রিকাটি যেভাবে তিরস্কার করেছে, তাতে এটা আরও স্পষ্ট হয়েছে সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়ও উপর্যুপরি তুষারপাতে জনজীবন অচল হয়ে যাওয়ার চিত্র ওই সব দেশের রাজনীতিকদের কিছুটা বিচলিত করে তুলেছে।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য আশার কথা এই যে সাম্প্রতিক ‘কনভেয়ার বেল্ট ওয়েদার ফেনোমেনন’ আটলান্টিকের উভয় তীরে যে জনভোগান্তির জন্ম দিয়েছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হার কমানোর বিষয়টিতে এসব শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলোকে এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে কিছুটা সক্রিয় হতে হবে। গত সপ্তাহান্তে তাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি চীন ও ইন্দোনেশিয়া সফরের সময় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হার কমাতে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য ওই দুই দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

দুই.
‘বাংলাদেশের মতো ব্রিটেন’ শিরোনামটি অবশ্য আমি অন্য আরেকটি ক্ষেত্রেও আংশিকভাবে প্রযোজ্য বলে মনে করি। আর সেই ক্ষেত্রটি হচ্ছে নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ এবং রাজনৈতিক সংকীর্ণতার তাড়নায় গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ এবং সংস্কৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কতিপয় বাংলাদেশি ‘যেকোনো উপায়ে পরাজয় এড়ানোর’ যেসব কৌশল ব্রিটেনে আমদানি করেছে বলে অভিযোগ উঠছে, তার পটভূমিতেই এ কথা বলা চলে (সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশির ক্ষেত্রে বিষয়টি সত্য নয়)।
ব্রিটেনের নির্বাচন কমিশন গত ৮ জানুয়ারি এক রিপোর্টে বলেছে যে দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী—বিশেষ করে পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি ব্রিটিশদের মধ্যে ভোট জালিয়াতির ঝুঁকি বেশি। শুধু ইংল্যান্ডের ১৬টি পৌর এলাকাকে চিহ্নিত করে কমিশন বলেছে যে তারা এসব এলাকায় ভোট জালিয়াতির ঝুঁকির বিষয়টি বিশেষভাবে খতিয়ে দেখছে। এলাকাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশিপ্রধান টাওয়ার হ্যামলেটস ছাড়াও বার্মিংহাম, ব্ল্যাকবার্ন, কভেন্ট্রি, ওল্ডহ্যাম, ব্রাডফোর্ড, স্পাও, পিটারবরার মতো পৌর এলাকা রয়েছে, যেসব জায়গায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করে। ভোট জালিয়াতির অন্যতম প্রধান একটি উপায় হচ্ছে ডাকযোগে ভোট। অভিযোগ রয়েছে, একটি এক বা দুই শয়নকক্ষের বাসাতেও ১৫-২০ জন ভোটার রেজিস্ট্রেশন করা হয়, যাঁদের অধিকাংশই ভুয়া অথবা অন্য এলাকার বাসিন্দা। তাঁদের ভোটগুলো প্রার্থীদের পক্ষে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলেই ভোটের ঝুলিটা বাড়ানো যায়।
ব্রিটিশ নির্বাচন কমিশন ডাকযোগে ভোট বন্ধ করার দাবিটি গ্রহণ না করলেও আগামী মে মাসে অনুষ্ঠেয় স্থানীয় সরকার এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগেই ভোটার রেজিস্ট্রেশন কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কমিশন একই সঙ্গে সুপারিশ করেছে যে ভোট দেওয়ার সময় ভোটারদের পরিচয়পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়ন করা হোক। সরকার কমিশনের সুপারিশকে স্বাগত জানানোয় ধারণা করা হচ্ছে, এই সুপারিশের আলোকে সরকার হয়তো নতুন আইন তৈরি করবে, তবে তা আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে সম্পন্ন হবে কি না, বলা মুশকিল।
ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিবিসিসি) দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারি। বণিক সমিতি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটেনে খুব যে প্রভাবশালী সে কথা বলা যাবে না। তবে বাংলাদেশে তাদের গুরুত্বই আলাদা। বাংলাদেশে ব্রিটিশ বিনিয়োগ বাড়ার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব আরও বাড়ছে বলেই মনে হয়। কিন্তু সেখানেও কোটারি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে সফল হিসেবে খ্যাত ইকবাল আহমেদ ও বিইসহ (প্রবাসী ব্যাংক-এর উদ্যোক্তা চেয়ারমান) ছয়জন পরিচালক ২ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি একটি কোটারি স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে এবং সংগঠনের গঠনতন্ত্র না মেনে স্বেচ্ছাচারের মাধ্যমে কয়েকজন সহযোগীর সদস্যপদ স্থগিত করেছে।
স্থানীয় বাংলা সংবাদমাধ্যমকে বিবিসিসির কর্মকর্তারা বলেছিলেন যে নির্বাচনের আগেই সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু সর্বশেষ খবর হচ্ছে, সমস্যা নিরসন ছাড়াই অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger