আশ্চর্য সব মানুষ by কাজল ঘোষ

রাজধানীর কিছু রাস্তায় যখন হাঁটি বা যানজটে থমকে গিয়ে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ কানে বাজে- কি এক ঘোর আমাকে তাড়া করে ফেরে। যেন নতুন এক স্বপ্নের ভুবন।
কোলাহল আর ভিড় ঠেলে কখনও যদি পাঁচতারা হোটেল সোনারগাঁওয়ের ফুটপাতে সন্ধ্যায় হাঁটাচলার সুযোগ হয় তাহলে খানিকটা থেমে কান পাতুন। শুনতে পাবেন পাখির সুতীব্র চিৎকার। শত হাইড্রোলিক  হর্নের আওয়াজ ভেদ করে আপনাকে যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে পাখিরা। হঠাৎ কোন এক বসন্তের দুপুরে রমনার ফুটপাত দিয়ে হাঁটলে কোকিলের মন্ত্রমুগ্ধ স্বর আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য ভুবনে। মৎস্য ভবনের মোড় থেকে ইস্কাটন গার্ডেনের সন্ধ্যার রূপ সত্যিই আমাকে নিয়ে যায় অনেক পেছনে। যেখানে আমি ম্যাচ বক্স নিয়ে সারি সারি গাছের ভিড়ে ঝিঁঝিঁ পোকা খুঁজে ফিরতাম আনমনে। এই স্বপ্নচারিতা শুধু আমাকে আবিষ্ট করে রাখে এক দল বৃক্ষ। যারা এক দল ক্ষমতালোভী মানুষের মতো স্বার্থপর নয়। যারা তাদের ছায়া দিয়ে এক মায়াঘেরা পরিবেশ রচনা করেছে যুগ-যুগান্তরে। অথচ কি বীভৎসতা আর নির্মমতা নিয়ে আমরা করাতে তাদের নির্মূল করেছি গত কিছুদিন। তা-ও গণতন্ত্রের নামে, মৌলিক অধিকারের নামে। অথচ আমরা সবাই জানি, সমাজ আর সভ্যতা বিনির্মাণে কি ভূমিকা এই গাছেদের। আমরা বেঁচে আছি গাছের অবারিত দানে। অট্টালিকা ঘেরা এই শহরে যতটুকু গাছ দেখি তা তো রাস্তার মাঝখানে অসহায়; ক্ষীণকায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু গাছ। এখানেও কালো থাবা। সেদিন বিজয়নগরের পথ ধরে যেতেই খেয়াল করলাম একটু পর পর কাটা গাছের গুঁড়ি। গত বছরের ৫ই মে জামায়াত-শিবির, হেফাজত আর জাতীয় পার্টির বিপথগামী কর্মীদের রোষানলের শিকার হয় বিজয়নগর থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত কয়েক শ’ গাছ। বিরোধী জোটের টানা অবরোধ আর হরতালে তা বিস্তৃত হয়েছে দেশজুড়ে। সাতক্ষীরা, যশোর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, পাবনা, সীতাকুণ্ড, গাইবান্ধা ও চাঁদপুর জেলার রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে শতবর্ষের হাজার হাজার গাছ রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়েছে। আগুনে পুড়ে মৃত্যু, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু আর দুর্বৃত্তদের চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হয়ে মৃত্যু হলেও পক্ষে বা বিপক্ষে বিবৃতি আসে। একে অন্যের দায় এ ওর ঘাড়ে চাপায়। কিন্তু করাতে বলি হওয়া গর্জন, শিরিষ, শিমুল, পলাশ, গামার, জারুল, ইউক্যালিপটাস, মেনজিন, গজারিরা ছটফট করলেও প্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। প্রকাশিত হিসাবে দেখা গেছে, গত ১০ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় ৫০ হাজারের বেশি গাছ কাটা পড়েছে। বেশির ভাগ গাছই এখনও পরিণত হয়নি। প্রতিটির দাম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। পরিণত হলে কমপক্ষে এই গাছের প্রতিটির মূল্য হতো ৩০ হাজার টাকা করে। গড়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার গাছ নিধন করা হয়েছে। নিধন হওয়া ৫০ হাজারের মধ্যে অন্তত ৪৫ হাজার গাছেরই মালিক সামাজিক বনায়নের ও ব্যক্তিমালিকানাধীন। এলজিইডির হিসাব অনুযায়ী তাদের ৩,৫১০টি, সওজের ২,৬৪০টি গাছ রাজনৈতিক সহিংসতায় ধ্বংস হয়েছে। অথচ এ ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে কোন পরিবেশকর্মী প্রতিবাদে সোচ্চার হননি। অথচ বিদেশী তহবিলের লোভে জলবায়ু সম্মেলনে দেশ বিভূঁইয়ে ঘুরে বেড়ানো আর নিজেদের বড় পরিবেশবাদী দাবি করার লোকও সংখ্যায় এদেশে অনেক। অনেকে বড় বড় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায়। এদের কেউই রাস্তায় দাঁড়াননি নির্মমভাবে বৃক্ষ নিধনের প্রতিবাদে। করেননি মানববন্ধন, সাদা পতাকা মিছিল। দোহাই আপনাদের, যে যেই দলেরই হোন না কেন এই নিরপরাধ গাছেদের এভাবে নিধন করবেন না। এরা আপনাদেরই জীবনদান করেছেন কালে কালে। শেষ করবো রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ক’টি লাইন দিয়ে- পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে, আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে...।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger