তাদেরকে সংখ্যালঘু বলতে হবে কেন by মতিউর রহমান চৌধুরী

তারা বাংলাদেশের নাগরিক। তবুও তাদের পরিচয় সংখ্যালঘু হিসেবে। আইনের দৃষ্টিতে এটা অগ্রহণযোগ্য। মোটেই কাম্য নয়। অথচ সেক্যুলার নন সেক্যুলার সবাই তাদেরকে সংখ্যালঘু বলে আলাদা করেন।
বাংলাদেশের সংবিধান আলাদা করার অনুমতি দেয় না। সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এখানে ধর্মকেও আলাদা করা হয়নি। ভোটার তালিকায়ও তাদের অবস্থানে কোন সরল রেখা টানা হয়নি।

বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুরা বরাবরই আলোচনায়। বিশেষ করে নির্বাচন এলে তাদেরকে নিয়ে সরব আলোচনা শুরু হয়। কারণে অকারণে তাদের ওপর আক্রমণ হয়। বাড়িঘরে চালানো হয় হামলা। অনেকের প্রাণও যায়। পাকিস্তানি শাসকেরা রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দিলেই পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে দাঙ্গা বাধিয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন। এটা অতীব পুরনো কৌশল। স্বাধীন বাংলাদেশেও আমরা এই চক্কর থেকে বের হতে পারিনি। প্রশ্ন হলো- প্রায় ২ কোটি হিন্দুকে আমরা সংখ্যালঘু বলছি কেন। তারা কি বাংলাদেশে সমান সুযোগ পাচ্ছেন না। যে কোন বিচারে তাদেরকে আলাদা করা যায় না। ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি-বাকরিতে তারা পিছিয়ে নেই। হিন্দুরা এখানে মন্ত্রী হচ্ছেন। এমপি হচ্ছেন। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ পাচ্ছেন। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিতেও তাদের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। এ নিয়ে কারও  কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ তারা যোগ্যতা অনুযায়ী এ পদগুলোতে আসীন হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে বিটিআরসি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থায়ও তাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের বিচরণ বরাবরই শক্ত ছিল। মিডিয়াতেও তারা পিছিয়ে নেই। আর রাজনীতি। সেখানেও তারা এগিয়ে যাচ্ছেন জোর কদমে। আওয়ামী লীগে হয়তো কিছুটা বেশি। বিএনপিই বা কম কিসে? দশ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতেও শক্ত অবস্থানে রয়েছে।
অন্যান্য কমিটি বা অঙ্গ সংগঠনেও একই ধারা অব্যাহত। রাজনীতি যেখানে দুটি মূল স্রোতে বিভক্ত। সেই দুটি স্রোতেই যেখানে হিন্দু সংখ্যালঘুদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে সেখানে এই নোংরা রাজনীতি কেন? কি কারণে আমরা তাদেরকে আলাদা করছি। এখানে তো সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিদ্যমান। ভারতের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে আমরা কেন তাদেরকে ব্যবহার করছি। নিছক রাজনীতি? না আর্থিক ফায়দা লাভ। তদন্তে দেখা যায়, এক শ্রেণীর মানুষ আছেন যারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে তাদেরকে ভিটেমাটিছাড়া করেন। সহায় সম্পত্তি কেড়ে নেন। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ থেকে ফায়দা তোলা হয়। এই জঘন্য কাজে আওয়ামী লীগ-বিএনপি কম-বেশি জড়িত। সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এমন এক রাজনৈতিক শক্তি এগিয়ে যা কিনা বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই।
সামপ্রতিক কতিপয় ঘটনা পর্যালোচনা করলে এটাই স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে রাজনীতিরই খেলোয়াড়রা সুবিধা নিয়েছেন। ব্লেম গেম তো আছেই। খালি খালি এখানে ভারত জড়িয়ে যায়। উদ্বেগ প্রকাশ করতে আপত্তি নেই। শরণার্থী শিবির খোলার কথা বলার মধ্যে অসহায়ের চিত্র ফুটে ওঠে। হিন্দুরা মনে করেন রাষ্ট্র বুঝি অসহায়। তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। তাছাড়া, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এখানে যারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু তাদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব এই সমাজের, এই রাষ্ট্রের। আমরা যদি তা নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে কিসের সেক্যুলারিজম। অসামপ্রদায়িকতার কথাই বা আমরা বলি কোন মুখে। হিন্দু সম্প্রদায়কেও এখানে স্বচ্ছ ভূমিকা রাখতে হবে। হিন্দুরা যে শুধু আওয়ামী লীগকে ভোট দেন তা নয় কিন্তু। বিপদটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের। বিএনপির মনোভাবেরও পরিবর্তন দরকার। গুজব কিংবা পত্রিকার রিপোর্ট দেখে এমন কোন মন্তব্য বা ধারণা পোষণ করা ঠিক হবে না যাতে করে আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে। জাতিগত বৈষম্য আখেরে কোন রাষ্ট্রকে স্বস্তি দেয়নি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি কি টিকে আছে কেবল ধর্মীয় বন্ধনে? মোটেই না। ধর্ম এখানে বৈরী নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল এটা। তখন ধর্মের কোন পরিচয় ছিল না। আমরা ছিলাম সবাই বাঙালি। এখন কেন ধর্মকে টেনে এনে বিভাজন সৃষ্টি করছি। এটার পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনও খেলা রয়েছে। যার যার ধর্ম পালন করেই আমরা দেশটিকে এগিয়ে নেবো এটাই তো জাতির প্রত্যাশা এবং প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সমপ্রদায় বার বার ময়লা রাজনীতির খেলার কাছে পরাজিত হবেন কেন? এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান দুই দলকে ভাবতে হবে। সংখ্যালঘুদেরকেও সাহস করে সত্য কথা বলতে হবে। কারা তাদের নিয়ে খেলা করে এটাও জাতির জানার দরকার আছে। সংখ্যালঘু তকমা থেকে তাদেরকে বের করার জন্য একটি সামাজিক আন্দোলন দরকার। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা যত তাড়াতাড়ি এই বিষয়টি সুরাহা করতে পারবেন ততই মঙ্গল। আধুনিক বিশ্বে জাতিতে জাতিতে বিভেদ সৃষ্টি করার কুফল বড় বেদনাদায়ক। সর্বোপরি বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজও বার বার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে দেখতে গিয়ে আওয়ামী লীগও বার বার তাদেরকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। তাদেরও কৌশল পরিবর্তন করা জরুরি। যদি তারা সংখ্যালঘু কার্ড সত্যি সত্যি খেলতে না চান।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger