যুক্তরাষ্ট্র- ‘বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসীদের’ নিয়ে উদ্বেগ by রাহীদ এজাজ

টুইন টাওয়ারে হামলার (৯/১১) পর গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট মার্কিন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বেড়েছে। জোরদার হয়েছে সন্ত্রাসবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও।
আর ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর ৯/১১-এর মতো তাণ্ডব চালানোর সামর্থ্য এখন আর আল-কায়েদার নেই বলেই ধারণা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। এর পরও স্বস্তিতে নেই যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, দেশটির অভ্যন্তরের বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গজিয়ে উঠেছে। গত এক দশকে দেশের নানা প্রান্তে বিচ্ছিন্নভাবে বেড়ে ওঠা এসব গোষ্ঠীকেই নিয়েই এখন উদ্বেগ মার্কিন প্রশাসনের। সন্ত্রাস আর জঙ্গি তৎপরতা থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের নজরদারি বেড়েছে। নিউইয়র্কে এ নজরদারিটা অভিবাসী এশীয় ও মুসলিমদের ওপর বেশি এবং খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

নজরদারি নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের ছবিটা নিউইয়র্কের ঠিক উল্টো। লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ বিভাগের (এলএপিডি) উপপ্রধান মাইকেল ডাউনিং জানান, অভিবাসী লোকজনের ওপর নজরদারি নয়, তাদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে সফল হতে হবে। এরই অংশ হিসেবে এলএপিডির কর্মকর্তারা বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা লোকজনের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনে যুক্ত থাকেন।
সামগ্রিকভাবে গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ঝুঁকি অনেকখানি কমেছে। এ জন্য দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এজেন্সি, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এফবিআই), জাতিসংঘের সন্ত্রাসবাদ দমন কমিটি, উইলসন সেন্টার, ব্রুকিংস ও র‌্যান্ডের মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ অভিমত পাওয়া গেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ফরেন প্রেস সেন্টার এ মাসের শুরুতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের গণমাধ্যমকর্মীদের সন্ত্রাসবাদ দমনবিষয়ক এক সফরের আয়োজন করে। এ সফরের অংশ হিসেবে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও লস অ্যাঞ্জেলেস সফর করি।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমন বিভাগের উপ-সমন্বয়কারী জাস্টিন সিবেরেল মনে করেন, আল-কায়েদার প্রভাববলয় গুঁড়িয়ে দেওয়া গেলেও ভৌগোলিকভাবে এর মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন স্থাপনায় হামলার ক্ষমতা হয়তো তাদের নেই। তবে ওসামা বিন লাদেনের জিহাদি আদর্শে তরুণদের প্রলুব্ধ করার ক্ষমতা আছে।
লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‌্যান্ড করপোরেশনের নীতিমালাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক এন্ড্রু লিয়েপমেনের মতে, লিবিয়ার বেনগাজিতে মার্কিন দূতাবাসে হামলা ও বোস্টন ম্যারাথনে বোমা হামলা সন্ত্রাসবাদ দমন নিয়ে নতুন করে ভাবনা জাগায়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে তো বটেই বিশ্বের নানা প্রান্তে ওসামা বিন লাদেনের আদর্শকে ধারণ করে অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এসব গোষ্ঠীর এজেন্ডাগুলো বৈশ্বিক না হয়ে আঞ্চলিক হয়ে পড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এরা খেলাফত প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করছে। তাই সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জয় হয়েছে বলাটা কঠিন।
র‌্যান্ড করপোরেশনের প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ব্রায়ান মাইকেল জেনকিন্স লাদেনের মতাদর্শের ভিত্তিতে দেশের নানা প্রান্তে বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন নেকড়ে হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, বিচ্ছিন্ন হলেও এসব গোষ্ঠী লক্ষ্যবস্তুতে হামলায় নিজেদের পারঙ্গম করে তুলছে। তবে মার্কিন সেনাবাহিনীর বিশেষ বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ব্রায়ানের ভয়টা আগামী দিনগুলো নিয়ে। কারণ, গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রায় দেড় হাজার মানুষ সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে, তাদের মধ্যে ৭০ জনেরও বেশি মার্কিন নাগরিক যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কতটা হুমকি সৃষ্টি করবে, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
লস অ্যাঞ্জেলেস শেরিফের দপ্তরের জরুরি ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জেফ রিব জানান, বিচ্ছিন্নভাবে দেশের নানা প্রান্তে এসব সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে উঠছে। বিশেষ করে, কারাগারে যাওয়ার পর চিরকুট বিনিময়সহ নানাভাবে যোগাযোগের মাধ্যমে এই সন্ত্রাসীরা পারস্পরিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। দেশের ভেতরেই সন্ত্রাসীরা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে, বিচ্ছিন্নভাবে এসব গোষ্ঠী বিকশিত হচ্ছে—এমন উদ্বেগ থেকেই নিরাপত্তা বাহিনীর সন্দেহ ও নজরদারি বেড়েছে।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের লিবার্টি অ্যান্ড ন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রোগ্রামের সহপরিচালক ফাইজা প্যাটেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ বা অপরাধমূলক কাজ করতে পারে—এমন সন্দেহের দৃষ্টি পড়ছে এশীয় ও মুসলমানদের ওপর। তাই মুসলমান তরুণেরা কখন, কোথায় যায় এবং মসজিদে ইমাম কী বলেন, সেদিকে তীক্ষ নজর রাখা হচ্ছে।
সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মুখোমুখি হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক মার্কিন তরুণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল নিউইয়র্কে। প্রায় দেড় দশক আগে মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ওই তরুণ পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁর কাছে জানা গেল মাস চারেক আগে এক ভোরে এফবিআই কর্মকর্তারা হাজির তাঁর বাড়ির দুয়ারে। এফবিআই কর্মকর্তাদের দেখে সংগত কারণেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তরুণের বাড়ির লোকজন। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দারা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে দপ্তরে যান। নিরাপত্তা সংস্থার লোকজনের প্রশ্ন শুনে তরুণটি বুঝে ফেলেন, বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি গোয়েন্দাদের নজরদারিতে ছিলেন। তিনি মুসলিম কি না, তাঁরা জানতে চান। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাঁকে বলেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে তিনি যেন তাঁদের অবহিত করেন।
মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তদেশীয় সহযোগিতার পাশাপাশি নিজেদের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সহযোগিতা বাড়ার কারণে নিরাপত্তার ঝুঁকি আগের চেয়ে কমেছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এজেন্সির ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানান, বিদেশি শত্রুদের বিরুদ্ধে আন্তসরকার সহযোগিতা করাই তাদের মূল কাজ। অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে তাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ ঠেকানো, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগকে মাথায় রেখে অভিবাসন ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে সহায়তা করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শুধু মানুষ নয়, পণ্য চলাচলের ওপরও দৃষ্টি রাখে ওই বিভাগ।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অর্ধেকটাই প্রচার মাধ্যমকেন্দ্রিক বলে মনে করে মার্কিন প্রশাসন। তাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাল্টা প্রচারণাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জঙ্গিদের বার্তা ব্যবহার করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের কাজের সমালোচনার মাধ্যমে জঙ্গিদের চরিত্র উন্মোচিত করার দাবি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের।
ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক কাউন্টার টেররিজম কমিউনিকেশনসের (সিএসসিসি) সমন্বয়ক আলবার্তো ফার্নান্দেজ জানালেন, ২০১১ সাল থেকে তাঁর দপ্তর প্রচারমাধ্যমে জঙ্গিদের এভাবেই প্রতিহত করছে।
আলবার্তো বলেন, ‘আমরা গত ডিসেম্বরে ইয়েমেনের রাজধানী সানার হাসপাতালে আল-কায়েদার নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভিডিও প্রচার করেছি। এরপর ওই ভিডিওতে প্রশ্ন তুলেছি ইসলাম ও শান্তির ডাক যারা দিচ্ছে, তারা কি আসলেই শান্তি চায়? এতে জনসমক্ষে তারা হেয়প্রতিপন্ন হয়েছে। ফলে ওই হামলার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে আল-কায়েদা। এ থেকেই লোকজন বুঝতে পারছে এদের স্বরূপ।’
শুরুতে সিএসসিসি প্রচারণা কার্যক্রমের বড় অংশটাই ছিল আরবিতে। এ ছাড়া সোমালি ভাষায়ও হয়। সম্প্রতি পাঞ্জাবি ও উর্দুর পাশাপাশি ইংরেজিতেও এ প্রচারণা শুরু হয়েছে। এমনকি জঙ্গিদের প্রতিটি ভিডিও বার্তা কিংবা প্রতিদিন ফেসবুক, টুইটারের প্রতিটি পোস্টের পাল্টা জবাব দেওয়া হয়।
তবে আল-কায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠন মোকাবিলায় নিজেদের সাফল্য নিয়ে আত্মতুষ্টি থাকলেও আলবার্তো ফার্নান্দেজ প্রতিপক্ষের দক্ষতা স্বীকার করতে ভোলেননি। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি জঙ্গি সংগঠনেরও মানসম্পন্ন প্রচারযন্ত্র রয়েছে, যাদের কর্মীরা যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন। তাদের প্রচারযন্ত্র যথেষ্ট দক্ষ, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও আগ্রাসী মনোভাবসম্পন্ন। তাই তাদের বিরুদ্ধে আমাদেরও আক্রমণাত্মক হয়েই লড়তে হচ্ছে।’
এর পরও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে বলে মত দেন সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা পল আর পিলার। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংসে কর্মরত পল মনে করেন, অনেক উদ্যোগের পরও যুক্তরাষ্ট্রের এখনো অনেক মৌলিক ঝুঁকি রয়ে গেছে। নতুন করে বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসী হামলা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

রাহীদ এজাজ: সাংবাদিক।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger