খোলা চোখে- সংখ্যালঘু রাজনীতির ‘সফট টার্গেট’ by হাসান ফেরদৌস

যাদের দিকে ঢিল ছুড়লে পাটকেল খাওয়ার ভয় নেই, যাদের বাড়িতে আগুন দিলে পাল্টা আগুন লাগার উদ্বেগ নেই, যাদের দু-চারজন খুন বা ধর্ষণ হলে ফিরতি খুন বা ধর্ষণের আশঙ্কা নেই—এমন মানুষজনই হলো ‘সফট টার্গেট’।
বাংলাদেশের জন্মের গোড়া থেকেই সংখ্যালঘু হিন্দুরা সে রকম ‘সফট টার্গেট’ হয়ে থেকেছে। একাত্তরে পাকিস্তানিরা বেছে বেছে হিন্দুদের ওপর হামলা করেছে। লক্ষ্য, হিন্দু জনগোষ্ঠীকে উৎখাতের মাধ্যমে ‘ফাইনাল সলিউশন’ অর্জন। পাকিস্তানিরা আর নেই, কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর চার দশকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ থামেনি। তার সর্বশেষ প্রমাণ মিলল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশজুড়ে সংখ্যালঘু উৎখাতের নতুন তাণ্ডবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘু গ্রাম আক্রান্ত হয়। লক্ষ্য, এসব গ্রামের লোকজন যাতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার দুঃসাহস না করেন। নির্বাচন শেষে আবারও তাঁরা আক্রান্ত হন, হুমকি ও শাসানি সত্ত্বেও কেউ কেউ ভোটকেন্দ্রে গেছেন এবং তাঁদের পছন্দের দলের বাক্সে ভোট দিয়েছেন, তার শাস্তি হিসেবে। এবারের সংখ্যালঘু আক্রমণের কারণও খুব ভিন্ন কিছু নয়। বাংলাদেশের হিন্দুরা বরাবরই আওয়ামী লীগকে নিজেদের রক্ষাকর্তা ভেবে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন, তা তারা সত্যি সত্যি রক্ষাকর্তা হোক বা না-ই হোক। প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামায়াত, যারা যেকোনো মূল্যে নির্বাচন ঠেকাতে বদ্ধপরিকর ছিল, বড় কর্তার গায়ে কুটোটি ছোঁয়াতে না পারলেও ঝাঁপিয়ে পড়েছে কুটোটি তুলে ধরার সাধ্য নেই যাদের, এমন সব অসহায় মানুষের ওপর। আক্রান্ত হয়েছে যশোরের মালোপাড়ার মৎস্যজীবী পরিবার, ঠাকুরগাঁওয়ের হিন্দুবাজার, দিনাজপুরের নিম্নবিত্ত হিন্দু গ্রাম। যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের অধিকাংশ এমনিতেই সমাজের প্রান্তবর্তী মানুষ, তার ওপর ধর্মীয় সংখ্যালঘু। নিজেরা দুর্বৃত্তদের পরিকল্পিত হামলার প্রতিরোধ করবে, সে ক্ষমতা তাদের নেই। সে কথা জেনেই এসব গ্রাম বা মহল্লা বেছে বেছে নেওয়া হয়েছে।
আক্রমণ হবে, এ কথা পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের যেমন জানার কথা, তেমনি জানার কথা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্তাব্যক্তিদেরও। এঁদের কারও পক্ষ থেকেই কোনো আগাম পাহারাদারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ভার এঁরা কেউই এড়াতে পারেন না। পুলিশ বা প্রশাসন ‘ওপরওয়ালার নির্দেশ নেই’ বলে পাশ কাটাতে পারে, কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা দায়িত্ব এড়াবেন কী বলে? হিন্দুদের তাঁরা চিরকালই নিজেদের ‘ভোটব্যাংক’ বিবেচনা করে এসেছেন। কিন্তু যাদের ওপর সংখ্যালঘু হিন্দুদের এত আশা, তারা কেউ কথা রাখে না। আগেও না, এবারেও না। চোর পালালে যেমন পুলিশ আসে, তেমনি ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হওয়ার পর এসব গ্রামে নিরাপত্তা টহল বসেছে। নাগরিক কমিটি গঠিত হয়েছে। সরকারের নেতারাও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির হুমকি দিয়েছেন। এ সবই বাতাসে তলোয়ার ঘোরানো ছাড়া আর কিছু নয়। যারা সব খোয়াল, এই কথার ফুলঝুরিতে তাদের কোনো লাভ হবে না।
এখন চোখের জল ফেলা ও কপাল চাপড়ানো ছাড়া মালোপাড়ার চন্দনা বিশ্বাস বা দেয়াপাড়ার কালীদাসী সরকারের অন্য আর করার কী আছে?
বাংলাদেশে একদল মানুষ আছে, যারা বরাবর হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বা তাদের প্রতি বৈষম্যকে ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বানানো গপ্প বা ‘মিথ’ বলে চালানোর চেষ্টা করে থাকে। ২০০১ সালে নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর যে অভাবনীয় নির্যাতন হয়, দেশের পত্রপত্রিকা তার সচিত্র বিবরণ ছেপেছিল। ছাপলে কী হবে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠ হয়েই বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে সেসব বাজে কথা বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়। পার্লামেন্টে একজন হাফ মন্ত্রী এমন কথাও বললেন, কোথাও কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। ঘটার সুযোগ থাকলে তিনি নিজেও তাতে অংশ নিতেন। তাঁর কথা শুনে সংসদের হলভর্তি মানুষ হেসে কুটি কুটি হয়েছিলেন।
আশার কথা, এবার বিএনপির নেত্রী মুখ ফুটে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। নিজের দলের বা ঘনিষ্ঠ দোসর জামায়াতের অংশগ্রহণের কথা তিনি স্বীকার করেননি, তবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারে সোচ্চার থাকার জন্য নিজ দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্দেশ পাঠিয়েছেন। সেটাও একধরনের স্বীকারোক্তি। নিদেনপক্ষে, এ যাত্রায় তাঁর দলের কোনো নেতা যে ‘নির্যাতন হলে আমরাও হাত লাগাতাম’ জাতীয় কথা আগ বাড়িয়ে বলেননি, তাকে একধরনের ‘প্রগ্রেস’ বলা যায় বৈকি!

মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, একটা দেশ ও তার মানুষ কতটা সভ্য, তা বোঝার একটা উপায় সে দেশের মানুষ নিজেদের দরিদ্র ও প্রান্তবর্তী মানুষ, বিশেষ করে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার কীভাবে রক্ষা করে, তা থেকে। গান্ধী নিজে সে অধিকার রক্ষায় নিজের জীবন পর্যন্ত খুইয়েছিলেন। সভ্যতার এই মানদণ্ডে আমরা বাংলাদেশের মানুষ খুব যে এগিয়েছি, তা বলা যাবে না। হিন্দু পেটানো আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যে হারে হিন্দু দেশত্যাগ করেছে, তা থেকেই ব্যাপারটা টের পাওয়া যায়। একসময় বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ ছিল। এখন তা কমতে কমতে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে। নিজের ভিটামাটি ছেড়ে এরা কেউ শখ করে দেশ ছাড়ে না, বিদেশে এদের অভ্যর্থনার জন্য কোনো তোরণও নির্মিত হয়নি। অথচ দেশের মন্ত্রী থেকে পাতিবুদ্ধিজীবী—সবাই একবাক্যে বলবেন, সব দোষ হিন্দুদের। ওদের এক পা এ দেশে, এক পা ও দেশে।
কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের বেছে বেছে নির্যাতন বস্তুত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। রাজনৈতিক গোলযোগের সূত্র ধরেও যদি তেমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে তাদের বিচারের সুযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, এসব ঘটনার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের সুযোগ রয়েছে। একই অপরাধে কেনিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সহকারীকে বিচারে হাজিরা দেওয়ার জন্য হেগে তলব করা হয়েছে।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব একা সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের নয়। দেশের মানুষেরও। যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তারা আমাদের প্রতিবেশী, আমাদের ভাই ও বন্ধু। চোখের সামনে নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটছে, তার প্রতিটি যথাযথ নথিবদ্ধ করা ও তদন্তের সব আলামত সযত্নে রক্ষা, যারা এসব ঘটনার সাক্ষী, তাদের আশু দায়িত্ব। অপরাধ করেও শুধু প্রামাণিক নথিপত্রের অভাবে যেন কেউ রেহাই না পায়, তা নিশ্চিত করার এখনই সময়।
নিউইয়র্ক

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger