জীবন বাঁচানো নায়কেরা by আলম পলাশ

গত ২৭ নভেম্বর, বুধবার। ভোর চারটা ৫০ মিনিট। জমজমাট চাঁদপুর স্টেশন। তার আগের দিন থেকে শুরু হওয়া অবরোধের ছোঁয়া সেখানে নেই বললেই চলে। ঠিক আর ১০ মিনিট পরে স্টেশন ত্যাগ করবে মেঘনা এক্সপ্রেস। গন্তব্য চট্টগ্রাম।
স্টেশনে প্রিয়জনকে বিদায় দিতে অনেকেই এসেছেন। ব্যাগ গুছিয়ে নির্দিষ্ট আসনে বসছেন যাত্রীরা। ব্যস্ত কুলি, হকার ও ট্রেনের কর্মচারীরা। এরই মধ্যে ট্রেনের হুইসেল পড়ে গেছে। তখন ভোর পাঁচটা। বিশালাকার অজগরের মতো হেলেদুলে চাঁদপুর স্টেশন ছাড়ল মেঘনা এক্সপ্রেস। স্টেশনের বাইরে কুয়াশা মোড়ানো ভোর। তবে সবচেয়ে ভয় জাগানো ব্যাপার হলো জায়গায় জায়গায় রেললাইন উপড়ে ফেলার খবর। ততক্ষণে অবশ্য বাংলাদেশ রেলওয়ের আগাম সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ‘অবরোধের সময় দেখে-শুনে ধীরগতিতে (নিয়ন্ত্রিত গতি) ট্রেন চালাতে হবে।’

সেভাবেই ট্রেন চালাচ্ছেন চালক জয়নাল আবেদিন ও সহকারী চালক আজম খান। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে পরবর্তী স্টেশনে পৌঁছারও তাড়া আছে। ট্রেন ছাড়ার পর এরই মধ্যে তিনটি স্টেশনে থেমেছে। যথারীতি যাত্রী উঠেছেন-নেমেছেন। ততক্ষণে ভোরের কুয়াশাও কাটতে শুরু করেছে। গাছগাছালির ফাঁক গলে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। ট্রেনের ভেতরে অনেকেই সকালের নাশতা সারছেন। পণ্য বিকোতে ব্যস্ত হকারেরা। টিকিট দেখতে ব্যস্ত টিটি। ব্যস্ত সামনের স্টেশনে নামার অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরাও। ৩ নম্বর স্টেশন হাজীগঞ্জ ছাড়ার পরপরই সবে গতি বাড়াতে যাবেন চালক, তখন তাঁর দৃষ্টি আটকে যায় সামনে। বিন্দুর মতো লাল কিছু একটা লাইন ধরে এগিয়ে আসছে ট্রেনের দিকে! পাশে বসে থাকা আজম খানকে ভালো করে খেয়াল করতে বলেন জয়নাল আবেদিন। আজমও তীক্ষ দৃষ্টিতে নজর রাখেন। সাদা কুয়াশার ভেতর লাল বিন্দুটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আরও একটু এগিয়ে এলে নিশ্চিত হন ‘ওই কিছু একটা’ আদতে একটা লাল নিশান। একটা বাঁশের আগায় লাল রঙের কাপড় বেঁধে ট্রেনের দিকে দৌড়ে আসছেন একজন বয়স্ক মানুষ। লাল মানেই দুর্ঘটনার সংকেত—ভালো করেই জানেন দুই চালক। কমিয়ে দেন ট্রেনের গতি। লাল নিশান হাতে বয়স্ক মানুষ আর ট্রেনের মধ্যে তখন দূরত্ব কমে এসেছে। লাফ দিয়ে নামেন আজম। বয়স্ক মানুষটির কাছে গিয়ে জানতে চান, ঘটনা কী? শীতের সকালে বয়স্ক মানুষ, অর্থাৎ তাজুল ইসলামের কপালে ঘাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, ‘সামনে রেললাইন অনেকখানি কাটা!’

ওরা তো আমার মতন কোনো মায়ের পুত!
ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস কৃষক তাজুল ইসলামের। সেদিনও উঠেছেন। নামাজ পড়েছেন। তারপর বাইরে বেরিয়েছেন। তাজুল ইসলামের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রেললাইন। প্রতিদিনই ভোরবেলা রেললাইনে গিয়ে কিছু সময় কাটান। ২৭ নভেম্বরও বের হয়েছিলেন। কিন্তু রেললাইনে বসতে গিয়ে তাঁর চোখ আটকে যায়। তাজ্জব ব্যাপার! কাল সন্ধ্যায়ও দেখেছেন রেললাইন ঠিক আছে। রাতের মধ্যে কী এমন হলো যে সেখান থেকে প্রায় ৬০ ফুট লম্বা   লোহার পাত হাওয়া! পাতগুলো পড়ে আছে খানিক দূরে। এখন উপায়! ঠিক একই সময়ে সেখানে হাজির হন শিবপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন। রেললাইনের পাশে বাড়ি হওয়ায় তাঁরা ভালো করেই জানেন, কখন কোন ট্রেন আসে-যায়। মেঘনা এক্সপ্রেস আসার সময় হয়ে এল প্রায়। কিছু একটা করতেই হবে—এই চিন্তা থেকেই দৌড়ে আবার বাড়িতে যান তাজুল। হাতে নেন উঠানের বাঁশে টাঙিয়ে রাখা স্ত্রীর লাল পেটিকোট। বাড়ি থেকে বের হতে গিয়ে হাতে নেন টেঁটা (বাঁশের তৈরি মাছ শিকারের বিশেষ অস্ত্র)। সেটার আগায় লাল পেটিকোটটি বেঁধে দ্রুত রেললাইনের ওপর চলে আসেন। দৌড়াতে থাকেন উয়ারুক স্টেশনের দিকে। অন্যদিকে আনোয়ার হোসেন ছুটতে থাকেন মেহের স্টেশনের দিকে। সেখানে পেয়ে যান এক রেলমিস্ত্রিকে। তাঁর মাধ্যমে যোগাযোগ করেন স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে। সতর্ক  করে দেন সম্ভাব্য বিপদের ব্যাপারে। স্টেশন মাস্টারও দ্রুত খবরটা পৌঁছে দেন  ট্রেনের গার্ডকে।

ওদিকে তাজুল ইসলাম দৌড়াচ্ছেন। একসময় তাঁর কানে আসে ট্রেনের হুইসেল। বাড়িয়ে দেন দৌড়ানোর গতি। ক্রমেই তাঁর সামনে স্পষ্ট হতে থাকে ট্রেন। চালক লাল নিশান দেখতে পেয়েছেন—এটা বুঝতে পারেন। ট্রেনের গতিও কমছে ধীরে ধীরে। খুব কাছাকাছি এসে থেমে যায় মেঘনা এক্সপ্রেস। এগিয়ে আসেন ট্রেনের গার্ড। নেমে আসেন চালকদ্বয়। জয়নাল আবেদিন বুঝতে পারেন, একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেল মেঘনা এক্সপ্রেস।

কথার ফাঁকে তাজুল ইসলামকে আমরা বলি, ‘আপনি তো সত্যিই অনেক বড় দায়িত্ব পালন করেছেন!’ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘যাত্রীরা তো আমার মতন কোনো মায়ের পুত (ছেলে)! হেগোর জীবন বাঁচানো আমার দায়িত্ব মনে করছি।’

আর আনোয়ার হোসেনের বক্তব্য, ‘চোখের সামনে এত বড় অ্যাকসিডেন হইব ভাইবা গা শিউরায় উঠতেছিল। কিছু না ভাইবাই দৌড় দিছি, মনে মনে ভাবতেছিলাম মানুষগুলারে বাঁচাইতে হইব।’

সাহসী প্রাণ

চাঁদুপরের শাহরাস্তি থানার পশ্চিম উপলতা গ্রামের তাজুল ইসলাম পেশায় কৃষক। তবে চাষ করার মতো নিজের কোনো জমি নেই। অন্যের জমিতে কাজ করেন। স্ত্রী, চার ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে পশ্চিম উপলতা গ্রামে রেললাইন ঘেঁষে বসবাস তাঁর। সন্তানদের মধ্যে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ে করিয়েছেন দুই ছেলেকে। বাকি দুই ছেলের মধ্যে একজন রাজমিস্ত্রি, অপরজন মুদির দোকানে কাজ করেন। সব মিলিয়ে টানাটানির সংসার। আনোয়ার হোসেনেরও একই অবস্থা। পেশায় করাতকলের শ্রমিক।

সেই ‘টেনে চলা সংসারে’ ট্রেন থামিয়ে দেওয়ার ঘটনা অনেকটা সুখের বার্তা বয়ে এনেছে। স্থানীয় সাংসদ, রেলমন্ত্রী, পুলিশ সুপার ও জেলা
প্রশাসক তাঁকে পুরস্কৃত করেছেন। সব মিলিয়ে তিনি পেয়েছেন প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার পুরস্কার। জানতে চাই, ‘এই টাকা দিয়ে কী করবেন?’ তাজুল ইসলাম খানিকটা চিন্তায় ডুব দেন, ‘ভাবছি দুইটা গাভি কিনব। গাভির দুধ বিক্রি করেই সংসার চলবে। অন্যের জমিতে আর কাজ করতে হবে না।’

‘আপনি তো একটা প্রশংসাপত্র পেয়েছেন।’—মনে করিয়ে দিতেই ঘর থেকে বের করে আনেন বাঁধাই করা প্রশংসাপত্র। চাঁদপুর পুলিশ সুপার মো. আমির জাফরের স্বাক্ষর করা প্রশংসাপত্রে শেষ দিকে লেখা, ‘তাজুল ইসলাম...দায়িত্বশীল, সুনাগরিকসুলভ ও সাহসী ভূমিকার মাধ্যমে একটি  যাত্রীবাহী ট্রেনকে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করেন। তাঁর ভূমিকায় আমরা গর্বিত।’
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger