সহিংসতা- এদের এখনই রুখতে হবে by আসাদুজ্জামান নূর

আমার নির্বাচনী এলাকায় কখনোই এ রকম সহিংসতা ঘটেনি। ২০০১ ও ২০০৮ সালে নীলফামারী-২ থেকে দুবার সংসদ সদস্য হিসেবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়েছি। আমার নির্বাচনী এলাকায় রাজনৈতিক উত্তেজনা হয়েছে, কিন্তু কখনোই সেটা সহিংসতায় রূপ নেয়নি। ফলে ঘটনাটি ছিল অভাবনীয়।

আমার নির্বাচনী এলাকার কোথাও কোথাও জামায়াতের ঘাঁটি আছে। এখানে আমার বিরুদ্ধে বিএনপি নয়, জামায়াতের প্রার্থীই দেওয়া হয়। সুতরাং, বিএনপির চেয়ে জামায়াত এখানে শক্তিশালী, সেটা বলাই যায়। কিন্তু এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ছিল, আছে। কখনো কখনো হালকা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, কিন্তু তা লাঠালাঠির পর্যায়ে ছিল না। আমরা কেউই অবস্থাটা এ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি কখনো।
সহিংসতার শুরু মাস ছয়েক আগে থেকে। যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর আদালতের রায় আসতে লাগল, তখন থেকে। সে সময় আমাদের পলাশবাড়ী ইউনিয়নের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন প্রামাণিক ও তাঁর চাচার ওপর জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গুরুতর আহত হয়ে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ইদানীং খবর পাচ্ছিলাম, জামায়াতের ক্যাডাররা রাস্তাঘাট কেটে ফেলছে, ব্রিজ খুলে নিচ্ছে। নীলফামারী শহরে কিন্তু এসব হচ্ছিল না। আমার নির্বাচনী এলাকা জেলা সদরে। জামায়াত চেষ্টা করছিল গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে। গ্রাম পর্যায়েও হরতালকারীদের সঙ্গে আমাদের উত্তেজনা ঘটেছে। কিন্তু তীব্র কোনো ঘটনা ঘটেনি।
১২ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে নীলফামারীতে এলাম। ১৩ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল। নির্বাচনী বিধিমালার কারণে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়ে গিয়েছিল। জাসদের প্রার্থীও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
১২ ডিসেম্বর রাতেই খবর পেয়েছিলাম, লক্ষ্মীচাপ ও পলাশবাড়ী ইউনিয়নে এসে হামলা করেছে, অগ্নিসংযোগ করেছে টুপামারি ইউনিয়নের জামায়াতের সমর্থকেরা। এখানে তারা বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপরে অমানুষিক অত্যাচার করেছে। বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় সেখানে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা ফায়ার ব্রিগেডও সেখানে যেতে পারেনি। ১৪ ডিসেম্বর আমরা লক্ষ্মীচাপের দিকে রওনা হই। লক্ষ্মীচাপে যাওয়ার সাধারণ রাস্তা দিয়ে যাওয়া হয়নি। পলাশবাড়ীর রাস্তা দিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা মোটরসাইকেল, গাড়িবহর নিয়ে পৌঁছালাম লক্ষ্মীচাপ। হাইস্কুল মাঠে আমরা সভা করেছি। সবাইকে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকতে বলেছি। যাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছিল ওরা, তাদের আশ্বস্ত করেছি। সেখানকার মেয়েরা বলল, রাতে তারা আতঙ্কে ঘরে থাকতে পারে না। বন-জঙ্গলে রাত কাটায়। আমার মনে হলো, একাত্তরেও তো এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। রাজাকার-আলবদরদের ভয়ে বাড়ি থেকে সরে থাকতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে! একাত্তরের বিভীষিকাকেই মনে করিয়ে দিল তাদের বিবরণ। কীভাবে এই নৃশংসতা ও নাশকতা প্রতিরোধ করা যায়, তা নিয়ে ভাবছিলাম। ঢাকায় এসে পরিকল্পনা করব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে বলব ইত্যাদি ছিল মাথায়। কিন্তু টুপামারির ভেতর দিয়ে আসার সময়ই দেখলাম, পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। গাছ কেটে রাখা হয়েছে, রাস্তা কেটে রাখা হয়েছে। আমরা কিছু গাছ আর ইট ফেলে রাস্তা ঠিক করে এগোতে থাকলাম। এই সময়ই হামলা শুরু হলো। রাস্তার দুদিকে ঢালু, নিচু ধানখেত। সেখান থেকে ইটপাটকেল মারতে লাগল ওরা। কারও হাতে চায়নিজ কুড়াল, কারও হাতে ধারালো ছুরি, রড। রামগঞ্জ বাজারে এসে পৌঁছানোর পথে বাজারের বিভিন্ন গলিপথ দিয়ে ওরা একযোগে আক্রমণ করতে থাকে আমাদের গাড়িবহরের ওপর। আমাদের গাড়িবহরের পেছনের অংশ আমাদের সঙ্গে কিছুটা বিচ্ছিন্ন ছিল। সেখানেই মূল আঘাত আসে। চারজন গুরুতর আহত হন, এর মধ্যে সেখানেই দুজন নিহত হন, দুজন মারা যান হাসপাতালে নেওয়ার পর। আহত অনেকের ঠাঁই হয়েছে নীলফামারী হাসপাতালে। গুরুতর আহতদের নেওয়া হয়েছে রংপুর হাসপাতালে। এই নাশকতার পর অপরাধীদের খুঁজতে বিজিবি, র‌্যাব রাতে গিয়েছিল সেখানে। কাউকে পায়নি। বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
এটা যে পূর্বপরিকল্পিত হামলা, তা নিয়ে আমার একেবারেই সন্দেহ নেই। ওরা আমাদের কয়েকজন কর্মীর হাত-পায়ের রগ এমনভাবে কেটেছে, যা পাকা হাতের কাজ। চিকিৎসকেরা বলেছেন, এগুলো প্রশিক্ষিত কেউ করেছে। এরা হয় বাইরে থেকে এসেছে, অথবা বাইরের কেউ এদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সেটা আমি বিশ্বাস করি। কারণ, নীলফামারীর মানুষ এ ধরনের সহিংস কাজে অভ্যস্ত বলে আমি মনে করি না। পরে শুনেছি, আক্রমণকারীদের অনেককেই এই এলাকার মানুষ চেনে না। এরা অন্য এলাকা থেকে এসেছে। এদের মূল টার্গেট আওয়ামী লীগের সমর্থক ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। ঠিক একাত্তরের মতোই।
জামায়াত-শিবির একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতোই নৃশংস হয়ে উঠেছে। তারা নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করছে, লুটতরাজ করছে; বাড়িতে, যানবাহনে আগুন লাগাচ্ছে। তাদের পাশবিক তাণ্ডবের ফলে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে মানুষ, কাতরাচ্ছে নারী ও শিশু, বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করছে কেউ কেউ, আতঙ্কে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে বহু মানুষ। একাত্তরে এই অত্যাচারী ঘাতকদের আমরা পরাজিত করেছি। কিন্তু তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বহু তরুণকে তারা ধর্মের নামে বিপথগামী করতে পেরেছে। এদের এখনই রুখতে না পারলে জাতি হিসেবে আমরা বিপন্ন হব।
নির্বাচনকে সুনির্দিষ্টভাবে মাথায় রেখেই আমরা আমাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছি। এবার সহিংস রাজনীতির জন্ম হতে পারে, সে রকম আশঙ্কা আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে। ফলে এ ধরনের তাণ্ডব মোকাবিলার ব্যাপারে আমাদের মানসিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছিল না। এই দুর্ঘটনা ঘটার পর আমি মনে করি, আমাদের মানসিক প্রস্তুতিরও খুব দরকার। সেই প্রস্তুতি থাকলে আমরা লড়াই করতে পারি, যেমন করেছিলাম একাত্তরে। এখনো সময় আছে। এখনই সাংগঠনিকভাবে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আপাতত আক্রান্ত এলাকা পলাশবাড়ী ও লক্ষ্মীচাপের সাধারণ মানুষই রাত জেগে দল বেঁধে নিজেদের পাহারা দিচ্ছে। এভাবেই গড়ে উঠবে প্রতিরোধ।

আসাদুজ্জামান নূর: সাংসদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger