রাজধানীতে ৫০০ কিশোর চালক by হায়দার আলী

রাজধানীর ব্যস্ততম প্রতিটি সড়কেই গাড়ি চালাতে দেখা যাচ্ছে কিশোর চালকদের। এসব কিশোরের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। তাদের বেশির ভাগেরই বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। কিশোর চালকদের কেউ কেউ বিআরটিএর লোকজনদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে ভুয়া লাইসেন্স তৈরি করে নিচ্ছে।

এসব লাইসেন্স দিয়ে তারা অনায়াসে গাড়ি চালাচ্ছে। কিছু কিশোর চালক বয়স বাড়িয়ে বিআরটিএ থেকে আসল লাইসেন্সও জোগাড় করে নিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া লাইসেন্সধারীরা ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্টদের ম্যানেজ করে নিয়মিত গাড়ি চালাচ্ছে। এসব কিশোর চালক রাজধানীতে সাধারণত লেগুনা, টেম্পো, হিউম্যান হলার চালায়। এ ছাড়া কখনো কখনো পিকআপ ভ্যান, মিনিবাসসহ অন্যান্য যানবাহনও চালায় তারা। শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশেই অপ্রাপ্তবয়স্করা গাড়ি চালাচ্ছে। মফস্বল এলাকায় নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালাচ্ছে। এসব যানবাহন এবং চালক উভয়েরই নেই বৈধ লাইসেন্স। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলছে।
হেলপার থেকে চালক : লেগুনা গাড়ির চালক মনির। এখনো মুখে গোঁফের রেখা দেখা দেয়নি। চার মাস হতে চলেছে গাবতলী থেকে মহাখালী পর্যন্ত লেগুনা চালায়। প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একাধিক ট্রিপ মারে। মনির কালের কণ্ঠকে বলে, 'তিন বছর গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করছি।
হেলপারি করতে করতে এখন নিজেই গাড়ি চালাই।' লাইসেন্স আছে কি না জানতে চাইলে মনির বলে, 'লাইসেন্স না থাকলে তো ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় গাড়ি চলতে দেবে না, তবে বয়স কম বলে আসল লাইসেন্স দিতে চায় না। কিছু টাকা দিয়া নকল লাইসেন্স বানাইতে হইছে।'
একই গাড়ির হেলপার আনিস (১৫) বলে, 'আমিও গাড়ি চালানো শিখে ফেলেছি। লাইসেন্স করতে দিছি। লাইসেন্স পাইলেই গাড়ি নিজেই চালামু।'
আদাবর বেড়িবাঁধ থেকে শ্যামলী রুটে এক বছর ধরে লেগুনা চালায় খোরশেদ হোসেন। বয়স সবে ১৫ পেরিয়েছে। খোরশেদ বলে, 'গাড়ি চালাইতে হলে বয়স লাগে নাকি? আমাগো চেয়ে অনেক বেশি বয়সের লোকও তো গাড়ি চালাইতে পারে না। মহল্লায় গাড়ি চালাইলে পুলিশ বেশি ধরে না। মালিকের লগে এলাকার নেতাগো খাতির আছে।' দুর্ঘটনার কথা তুললে খোরশেদের জবাব, 'গাড়ি চালাইলে তো কিছু না কিছু এঙ্েিডন্ট হইব।'
মনির আর খোরশেদের মতোই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ১৪ থেকে ২০ বছরের পাঁচ শতাধিক কিশোর গাড়ি চালাচ্ছে। তাদের বেশির ভাগই ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালায়। গাবতলী কিংবা মিরপুর থেকে ছেড়ে আসা অনেক মিনিবাসের চালকও কিশোর। মূল চালক না এলে মালিকরা হেলপারদের দিয়েই বাস রাস্তায় নামিয়ে দেন। কখনো ট্রাফিক পুলিশ ধরলে কিছু টাকা দিলেই ছেড়ে দেয় বলে কিশোর চালকদের অনেকেই এ প্রতিবেদককে জানায়।
বেপরোয়া গাড়ি চালানো : কিশোর চালকরা রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণেই সড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ঘটাচ্ছে একের পর এক দুর্ঘটনা। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অদক্ষ কিশোর চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে বেশির ভাগ সময় দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত গাড়ির চালকরাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
মহাখালী থেকে টাঙ্গাইলগামী নিরালা পরিবহনের চালক আনিসুর রহমান বলেন, '২০ বছর ধরে রাস্তায় গাড়ি চালাই, কিন্তু এখন কয়েক মাস হেলপারি করেই রাস্তায় অল্প বয়সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অল্প বয়সের চালকের উল্টাপাল্টা চালানোর কারণে আমরা অনেক সময় বিপদে পড়ে যাই। তাদের কারণেই রাস্তায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।' একই কথা বলেছেন এস এ খালেক পরিবহনের চালক মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, 'কিশোর চালকরা গাড়ি চালানোর সময় নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা করে না। তারা নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো গাড়ি চালানোর কারণে রাস্তায় এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। তাদের কারণে আমাদের মতো দক্ষ চালকরা বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছি।'
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিশোর চালকদের অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালায়। রাতভর মাদক গ্রহণ করে দিনের বেলায় গাড়ি চালাতে গিয়ে শারীরিক ভারসাম্য হারিয়েও দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশিক্ষিত চালকের অভাব, পথচারীদের অসতর্কতা, ফিটনেসহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, গাড়ির অতিরিক্ত গতি, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি, অতিরিক্ত গাড়ি, ত্রুটিপূর্ণ সেতু এবং অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের কারণেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
লাশের মিছিল : জানা যায়, সারা দেশে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী ও লাইসেন্সবিহীন চালক রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে প্রায় ৮৬ হাজার। আর লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকদের মধ্যেও রয়েছে অদক্ষ চালকের ছড়াছড়ি। ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলায় অসংখ্য কিশোর চালক রয়েছে। মফস্বলের প্রতিটি রাস্তায় দারিদ্র্যের কারণে ১২ থেকে ২০ বছর বয়সের হাজার হাজার কিশোর চালক নির্বিঘ্নে গাড়ি চালাচ্ছে। যানবাহন আইন সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই তাদের। ফলে প্রতিদিনই ঘটছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে বহু মানুষ। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে দিন কাটাচ্ছে। বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ নিবন্ধিত যানবাহনের বিপরীতে বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। বাকি সাড়ে পাঁচ লাখ গাড়ি চালাচ্ছে ভুয়া লাইসেন্সধারীরা। বেসরকারি পরিসংখ্যানে ঢাকাসহ সারা দেশে ৬১ শতাংশ চালক বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালাচ্ছে। দেশে ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছে এক লাখ তিন হাজার জন। এর মধ্যে মারা যায় ৫০ হাজার ৫৪৪ জন। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে দুই হাজার ৮২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট হতাহত হয়েছে চার হাজার ৪৪৯ জন। অন্যদিকে সেন্টার ফর মিডিয়া রিসার্চের (এমআরটি) বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বলা হয়েছে চার হাজার ৪৮১ জন। মৃত্যুর হার গড়ে প্রতিদিন ১২ জনেরও বেশি। এসব ঘটনায় ১৫ হাজার ৫৬৯ জন অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪২ জনেরও বেশি মানুষ আহত হচ্ছে বলে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিআরটিএ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এঙ্েিডন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ড. শামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সড়ক দুর্ঘটনা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই দুর্ঘটনার খবর পাই। এ ছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশেই অদক্ষ এবং কিশোর চালক রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে। নসিমন, করিমন, ভটভটিসহ হাজার হাজার গাড়ির বেশির ভাগ চালক কিশোর।'
তাঁর মতে, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে প্রতিটি সড়কে রোড ডিভাইডার স্থাপন করার পাশাপাশি চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন পরিস্থিতি ভয়াবহ। বছরে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার দুর্ঘটনার হিসাব রাখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে ওস্তাদের কাছ থেকে গাড়ি চালানো শেখার সংস্কৃতির কারণে চালক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় দেশের ছয়টি বিভাগে ছয়টি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আমাদের রয়েছে।'
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger