মণিপুরি তাঁত শিল্প কি হারিয়েই যাবে?

সিলেট বলতেই যে দুই-তিনটি বিষয় সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার অন্যতম মণিপুরি তাঁত শিল্প। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে এর চাহিদা ও খ্যাতি ছড়িয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি তাঁত শিল্প সময়ের ব্যবধানে আজ বিলুপ্তির পথে। প্রয়োজনীয় মূলধন, প্রশিক্ষণ আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্প। অথচ প্রতিকূলতা কাটাতে পারলে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মণিপুরি তাঁত শিল্প হতে পারত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম।
বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় মূলত অধিকাংশ মণিপুরি বসবাস করে। সিলেট নগরীর মাছিমপুর, লালদীঘিরপাড়, লামাবাজার, জল্লারপাড়, রাজবাড়ি, মির্জাজাঙ্গাল, বাগবাড়ি, সাগরদীঘিরপাড়, সুবিদবাজার, মিরের ময়দান, আম্বরখানা, কুশিঘাট, গোয়াইপাড়া, খাদিমনগর, গঙ্গানগর এলাকায় মণিপুরি সম্প্রদায়ের বসবাস। মণিপুরি পরিবারের মহিলারা তাঁতে কাপড় বোনার ব্যাপারে স্বশিক্ষিত এবং তারাই মূলত এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাদের নিপুণ হাতে তৈরি বৈচিত্র্যময় নকশাখচিত মনিপুরি বস্ত্র দেশের পাশাপাশি বিদেশেও সমাদৃত। পর্যটকরা সিলেটে এলে তাই খোঁজ করে মণিপুরি তাঁতবস্ত্রের। ২০০৪ সালে জার্মানি ও ইতালিতে এবং ২০০৭ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় মনিপুরি তাঁতবস্ত্র ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। এর আগে ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকার বস্ত্র মেলায় মণিপুরি তাঁতের স্টল দেওয়া হয়েছিল। ওই মেলায় মণিপুরি তাঁতবস্ত্র সম্মানসূচক পুরস্কার অর্জন করে। প্রতিবছর ব্যক্তি উদ্যোগে প্রচুর মনিপুরি বস্ত্র বিদেশে গেলেও যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় এখনো সরাসরি বিদেশে বাজারজাত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি এ পণ্যের।
সাধারণত মণিপুরী মহিলারা নিজেদের পরিবারের ব্যবহারের পোশাক কোমর তাঁতে নিজেরাই তৈরি করে। পাশাপাশি ঘরে উৎপাদিত বাড়তি কাপড়গুলো তারা বিক্রি করে। এই কাপড় নিয়ে নগরীর কিছু এলাকায় কেবল মণিপুরি বস্ত্রের দোকান গড়ে উঠেছে। লামাবাজার, জিন্দাবাজার, শাহজালাল (রহ.) দরগাগেট, সুবিদবাজার, খাদিমনগর এলাকায় বেশ কিছু মণিপুরি কাপড়ের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে মণিপুরিদের তৈরি শাড়ি, চাদর, বিছানার চাদর, গামছা, মাফলার, ওড়না, থ্রিপিস, ব্যাগ, টেবিল ক্লথ পাওয়া যায়। এসব পণ্যের রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। এ কারণেই তা অনেকের পছন্দের জিনিস। মণিপুরি নারী সত্যবামা দেবী জানান, আগে কেবল বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও মেলায় মণিপুরি তঁাঁতবস্ত্রের স্টল দেখা যেত। এখন নগরীর অনেক এলাকায় মণিপুরি বস্ত্রের স্থায়ী দোকান গড়ে উঠেছে।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মণিপুরি বস্ত্রের ফ্যাশনেও এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। তবে মনিপুরি তাঁত শিল্পের বিকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্রে তার ছাপ পড়েনি। বরং নানা সংকটের কারণে নতুন প্রজন্ম এই শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে, সরে যাচ্ছে এ পেশা থেকে। এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানায়, তাদের বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত তাঁত শিল্প আজ গভীর সংকটের মুখে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে এই শিল্পকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর এই শিল্পের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও দুষপ্রাপ্যতা, সেই সঙ্গে ভারতীয় পণ্যের আগ্রাসনে মণিপুরি তাঁত শিল্প পার করছে চরম সংকটকাল। তাতে মণিপুরিরা ক্রমেই আগ্রহ হারাচ্ছে তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের ব্যাপারে।
কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে জানিয়ে নগরীর লামাবাজারের সিলেট মণিপুরি শাড়ি ঘরের বিক্রয়কর্মী মঙ্গলা দেবী বলেন, 'সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি বস্ত্রের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধি করতে হয়েছে। এতে করে বেচাকেনা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এভাবে চললে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।' সংশ্লিষ্টরা জানায়, তাঁতের একটি শাড়ি বুনতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লাগে। চাদর তৈরি করতে লাগে দুই থেকে চার দিন। কিন্তু তৈরিকৃত পণ্য বিক্রি করে সে তুলনায় পারিশ্রমিক পাওয়া যায় না। তাঁরা অভিযোগ করে বলেন, বাজারে অবাধে ভারতীয় শাড়ি ও চাদর আসায় এসব কাপড়ের সঙ্গে মণিপুরিদের হাতে তৈরি কাপড় প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছে। তাঁদের প্রশ্ন, সাত-আট দিনে একটি শাড়ি তৈরি করে পর্যাপ্ত দাম না পেলে কাপড় বুনে লাভ কি। তাই বর্তমানে যারা বিকল্প কাজ পাচ্ছে না, কেবল তারাই একেবারে বেকার থাকার চেয়ে ঘরে বসে কাপড় তৈরি করছে। একসময় মণিপুরি মহিলাদের প্রায় সবাই তাঁতে কাপড় বুনলেও এখন তাদের অনেকেই পা বাড়াচ্ছে বিকল্প পেশার দিকে। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটের মণিপুরি সম্প্রদায়ের অল্পসংখ্যক লোকই বাণিজ্যিকভাবে কাপড় তৈরির সঙ্গে জড়িত।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় অনেকে অর্থের সংস্থান করতে বিভিন্ন এনজিওর দ্বারস্থ হচ্ছে। কিন্তু চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সুবিধা করতে পারছে না। তারা জানায়, কোমর তাঁত বসাতে বেশি পুঁজি লাগে না বলে এটি অনেক মণিপুরি পরিবারেই বসানো হয়। কিন্তু এতে বেড শিট, বেড কাভার, পিলোর মতো হাতেগোনা কয়েকটি পণ্য ছাড়া অন্য কোনো বস্ত্র বোনা যায় না। শাড়ি, থ্রিপিস, ওড়নার মতো পরিধেয় বস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তাঁত বসানোর ব্যয় অনেক বেশি। একটি যন্ত্রচালিত ব্রড ব্র্যান্ডের তাঁতের সরঞ্জাম কিনতে ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগে। তাই যাদের পুঁজি কম, তারা বাধ্য হয়ে কোমর তাঁত ব্যবহার করে। পুঁজির অভাব ছাড়াও আরো কিছু কারণে মণিপুর িতাঁত শিল্পের প্রসার হচ্ছে না। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানায়, 'প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সিলেটে পাওয়া যায় না। নরসিংদী ও ঢাকা থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হয়।'
১৯৭৯ সালে সমাজকল্যাণ ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১০টি তাঁত দিয়ে সিলেট নগরীর শিবগঞ্জে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র উৎপাদন শুরু হয়েছিল। পরে সরকারি সাহায্য বন্ধ এবং প্রশিক্ষণ ও কাঁচামালের অভাব দেখা দেয়ায় চালু হওয়ার আট বছরের মাথায় তাঁতগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের আগস্টে বাংলাদেশ মণিপুরি আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে মহিলা তাঁতি সম্মেলনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী মণিপুরি তাঁত শিল্পের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার আশ্বাস দেন। তবে পরে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। মণিপুরি তাঁত শিল্পের আধুনিকায়নে কোনো ধরনের উদ্যোগ না নেওয়ায় মান্ধাতার আমলের ধারায় এখনো চলছে এর বুনন ও উৎপাদন কাজ। পাশাপাশি সরকারিভাবে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ না থাকায় ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে মণিপুরি তাঁত শিল্প।
বাংলাদেশ মণিপুরি মহিলা সমিতির চেয়ারপারসন এস রিনা দেবী বলেন, 'ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। পাশাপাশি এই শিল্পে নিয়োজিতদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং ঋণ সুবিধা দিলে এটি আরো বিকশিত হবে।' তিনি বলেন, 'আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ শিল্পকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। এর ফলে দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আসবে।'
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger