বিদায় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা

বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই পাস হয়েছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন বিল। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রথমে কণ্ঠভোটে এবং পরে বিভক্তি ভোটে পাস হয় বিলটি। এ বিল পাস হওয়ায় সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত হয়েছে। পুনর্বহাল হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও বহাল রাখা হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও বিসমিল্লাহ। দুই সামরিক শাসকের আমলে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করা হয়েছিল সংবিধানে।
অবশ্য বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির দুই সদস্য আপত্তি জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাবও দিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে সর্বোচ্চ আদালতও বলেছিলেন, সংবিধানকে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে পরিবর্তনের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে।
সংসদীয় আনুষ্ঠানিকতার পর গতকাল সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া চলাকালে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত ছিল।
সংশোধিত সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হলেও অন্যান্য ধর্মও পেয়েছে সমমর্যাদা ও অধিকার। ২(ক) অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, 'হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করবে।'
বাম দল ও সুধী সমাজের একটি অংশের দাবি থাকলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি সংশোধিত সংবিধানে। অবশ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার বা জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে কোনো সংগঠন করা যাবে না বলে এতে উল্লেখ রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৩৮-এ বলা হয়েছে, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে গঠিত কোনো সংগঠনও কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না।
স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে গতকাল শুরু হওয়া সংসদ অধিবেশনে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বিলের ওপর জনমত যাচাই এবং বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন স্বতন্ত্র সদস্য মো. ফজলুল আজিম। তাঁর এই প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর বিলটির ওপর সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের হাসানুল হক ইনু, মইনউদ্দীন খান বাদল ও শাহ জিকরুল আহমেদ, ন্যাপের আমিনা আহমেদ, আওয়ামী লীগের সাবের হোসেন চৌধুরী ও কামাল আহমেদ মজুমদার এবং স্বতন্ত্র সদস্য মো. ফজলুল আজিম। তাঁদের ৬৫টি সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়নি। সব প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায় কণ্ঠভোটে। পরে বিলটি পাসের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং বেলা ২টা ৫৩ মিনিটে বিভক্তি ভোটের ফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিলটি পাস হয়।
'এবার পাস হলো দিনের আলোতে'
স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বিভক্তি ভোটের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মহাজোটের সদস্যরা টেবিল চাপড়ে অভিনন্দন জানান। ওই সময় স্পিকার বলেন, 'এর আগে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হয়েছে রাতের আঁধারে। আর এবার পাস হলো দিনের আলোতে।' পরে তিনি এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফ্লোর দেন।
বিপক্ষে এক ভোট
সংসদে বিলটি বিভক্তি ভোটের আগে বেলা ২টা ২৫ মিনিটে কণ্ঠভোটে পাস হয়। বিলটি পাসের পক্ষে ২৯১টি এবং বিপক্ষে একটি ভোট পড়ে। এর আগে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংশোধনীসহ বিলটি পাসের জন্য বিবেচনার প্রস্তাব গ্রহণকালে বিভক্তি ভোটে পক্ষে ২৮৯টি এবং বিপক্ষে একটি ভোট পড়ে। বিলটি পাসের সময় দুজন বেশি ভোট দিয়েছেন। আর তিন টেকনোক্র্যাটমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, দিলীপ বড়ুয়া ও ইয়াফেস ওসমান সংসদে থাকলেও তাঁরা ছিলেন দর্শক।
সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হওয়ায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচন হবে দলীয় সরকারের অধীনে। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও গঠন করা হবে অনধিক পাঁচ সদস্যের শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। আর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশ করা পর্যন্ত অর্থাৎ নির্বাচনী মেয়াদে নির্বাচন সংক্রান্ত মামলায় নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য না শুনে কোনো আদেশ দেবে না আদালত_এমন বিধান যোগ করা হয়েছে।
সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তাঁর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানে সংশোধনী এনে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংবিধান সংশোধন করে অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবৈধ ক্ষমতা দখলকে অপরাধ বিবেচনায় রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অপরাধে দোষী ব্যক্তি নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
সংশোধিত বিল অনুযায়ী সংবিধানে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশ নামে ২৩ (ক) নতুন অনুচ্ছেদ সনি্নবেশিত হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এ ছাড়া সংসদে নারী আসন আরো পাঁচটি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
মৌলিক বিধান সংশোধন অযোগ্য
সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হওয়ায় আগামী দিনে সংবিধানের মৌলিক বিধান সংশোধনের সুযোগ থাকবে না। সংবিধানের মৌলিক বিধান সংশোধনের অযোগ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, 'এ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহাই কিছু থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথমভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম ক-ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের অনুচ্ছেদ ১৫০-সহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।'
বামপন্থী সদস্যদের নিয়ে জটিলতা
সংবিধান সংশোধন বিলের ওপর বিভক্তি ভোটগ্রহণের সময় মহাজোটের শরিক বামপন্থী দলগুলোর সদস্যদের নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। তাদের ভোট নিয়ে টেনশন বেড়ে যায় আওয়ামী লীগের শীর্ষমহলে। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও ন্যাপের ছয় সংসদ সদস্য বিলের কয়েকটি দফায় সংশোধনী প্রস্তাব দেন। এসব প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান আইনমন্ত্রী। এতে নাখোশ হন বাম নেতারা। তাঁরা সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্যরা তাঁদের বোঝান, ভোটদানে বিরত থাকলে ফ্লোর ক্রসিং হবে এবং সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। কারণ সব বাম নেতাই আওয়াম লীগের প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। এ পরিস্থিতিতে বাম নেতারা দোটানায় পড়ে যান। পরে আধা ঘণ্টা পর্যালোচনা শেষে তাঁরা বিভক্ত ভোটে অংশ নিতে সংসদ লবিতে যান। তবে তাঁরা তাদের সংশোধানীগুলো উল্লেখ করে ভোট দেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, পলিটব্যুরো সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, কার্যকরী সভাপতি মঈন উদ্দীন খান বাদল, শাহ জিকরুল আলম ও ন্যাপের আমিনা আহমেদ সংবিধান সংশোধন বিলে বেশ কয়েকটি সংশোধনীর প্রস্তাব দেন। এসবের মধ্যে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং জাতি হিসেবে বাঙালি শব্দগুলো বাতিল করার প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু আইনমন্ত্রী তাঁদের এসব প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। কণ্ঠভোটেও এসব প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। পরে সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিভক্তি ভোট অনুষ্ঠিত হলে স্পিকার বলেন, যাঁরা সংশোধনীর পক্ষে ভোট দেবেন, তাঁরা 'হ্যাঁ' লবিতে যাবেন, আর যাঁরা 'না' ভোট দেবেন, তাঁরা 'না' লবিতে যাবেন। যাঁরা ভোটদানে বিরত থাকবেন, তাঁরা সংসদের নিজ আসনে বসে থাকবেন। বিভক্তি ভোট চলাকালে নিজ আসনে বসে থেকে ভোটদানে বিরত থাকেন বাম নেতারা। এতে আওয়ামী লীগের ভেতরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বাম নেতাদের কাছে ছুটে যান তোফায়েল আহমেদ, শেখ সেলিম, ফজলে রাবি্ব, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ অনেকে। তাঁরা বারবার তাঁদের ভোট দিতে অনুরোধ করেন। এ অনুরোধ বাম নেতারা প্রত্যাখ্যান করলে একসময় ক্ষুব্ধ হয়ে সৈয়দ আশরাফ ও শেখ সেলিম প্রধানমন্ত্রীর কাছে যান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁরা পরিস্থিতির বর্ণনা দেন। এ পর্যায়ে অ্যাডভোকেট ফজলে রাবি্ব সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধি নিয়ে বাম নেতাদের বোঝাতে থাকেন। পরে তাঁরা সংসদ লবিতে গিয়ে ভোট দেন।
সংবিধান সংশোধনের জন্য গত বছরের ২১ জুলাই সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারপারসন করে সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। গত ৮ জুন ৫১টি সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করে বিশেষ কমিটি। এ সুপারিশের আলোকে প্রস্তুত করা বিলে ২০ জুন মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়। এরপর ২৫ জুন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সংসদে বিলটি উত্থাপন করলে তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি ২৯ জুন সংসদে প্রতিবেদন উত্থাপন করেন।
এ বিল পাসের প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলকে যুক্ত করার জন্য একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger