মূর্ত-বিমূর্তের কবি by কাইয়ুম চৌধুরী

বেশ কয়েক দিন ধরেই বুঝতে পারছিলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়াকে আমরা বোধ হয় আর ধরে রাখতে পারব না। বাসা আর হাসপাতাল—এই দুয়ের মধ্যে ছোটাছুটি। কষ্ট হচ্ছিল। হূদ্যন্ত্র খুব দুর্বল। নিঃশ্বাস পরিপূর্ণভাবে নিতে পারছেন না। ফুসফুসে পানি জমে যাচ্ছে। সব সময় অস্থির। বিছানায় বসিয়ে দিতে বলছেন। আবার পরক্ষণেই বলছেন শুইয়ে দিতে। দুই হাতের মধ্যে হাত টেনে নিলাম। চোখ খুলে তাকালেন। বললেন, ‘কাইয়ুম, বড় একা, একা লাগে।’ সান্ত্বনাবাক্য নেই। এই একাকিত্বের জন্য তো আমরাই দায়ী।

একবার দেখতে গেছি তো আর দেখা নেই। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে কী ভালোই না বাসতেন। কত কথা শিল্প সম্পর্কে, শিল্পী সম্পর্কে। শিল্প আছে বলেই তো পৃথিবীটা বাসযোগ্য। পৃথিবীকে, মানুষকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে সুন্দর সৃষ্টি দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়াই তো শিল্পীর কাজ।
আমার হাতে একটু চাপ দিয়ে খুব ধীর লয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাইয়ুম, আমি কি কিছু করতে পেরেছি?’ জীবনসায়াহ্নে এসে কিবরিয়া সাহেব কি নিজেকে মূল্যায়ন করতে চাইছেন? জীবনের হিসাব-নিকাশ এই সময়ে কেন? তিনি কি অনুভব করছেন, তাঁর আর কিছু করার নেই? ঘর্মাক্ত হাতটি টেনে কপালে রাখলাম। বললাম, ‘কী বলছেন আপনি? বাংলাদেশের চিত্রভুবনে আপনি একটি নতুন শৈলীর জন্ম দিয়েছেন। বেগবান করেছেন চিত্র-আন্দোলনকে। আমাদের নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে আপনারই অনুসারী আছে। আর তো কারও নেই।’
বাংলাদেশের চিত্রকলাকে যাঁরা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছেন, কিবরিয়া সাহেব তাঁদের অন্যতম। আমাদের চিত্রভুবন সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর চিত্রের মাধ্যমে। বিমূর্ত চিত্রকলাকে একটি নতুন মাত্রায় উপস্থাপিত করেছেন ক্যানভাসে। কিন্তু শুরুটা তাঁর এ রকম ছিল না। তাঁর বিষয়ভিত্তিক রচনা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। পঞ্চাশের দশকে তিনি যখন নবাবপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছেন, থাকতেন আজিমপুর সরকারি কর্মচারীদের জন্য নির্মিত কোয়ার্টারে। একটি কক্ষে সাত-আটজনের সঙ্গে তাঁর বসবাস। কাঠের চৌকির মাথায় বংশদণ্ডের সঙ্গে বাল্ব ঝুলিয়ে মেঝেতে চটের ওপর বসে চৌকির গায়ে ক্যানভাস ঠেকিয়ে ছবি আঁকতেন। বাল্বের চারদিকে কাগজের ঘেরাটোপ, রুমমেটদের যাতে অসুবিধা না হয়। এঁকেছেন ‘পাখি হাতে বালক’, ‘চন্দ্রালোকে ঘোড়া’, ‘সাঁতার’, ‘মা ও ছেলে’ প্রভৃতি ছবি। বেশির ভাগ ছবির রং তখন অনুজ্জ্বল, বিষাদগ্রস্ত। বীরভূম থেকে চলে এসেছেন পূর্ব বাংলায়। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, একাকী। একটা ছবির কথা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ছে—কয়েকটা সদ্য নির্মিত কবরের সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত একজন, তিনি কিবরিয়া। প্রশ্ন রেখেছিলাম, কেন এই বিষণ্নতা? মৃদু স্বরে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘প্রতিবছরই পরিবারের কেউ না-কেউ আমাদের ছেড়ে চলে যেত। একটা নিঃসঙ্গতাবোধ ভেতরে কুরে কুরে খেত।’
সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি ও পাজামা, পায়ে স্যান্ডেল—এই বেশে কিবরিয়া সাহেবকে প্রথম দেখি। মৃদু কণ্ঠ, আগ বাড়িয়ে কথা বলেন না। জয়নুল আবেদিন যখন তাঁকে আর্টস্কুলে চাকরিতে নিয়ে এলেন, তখন অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। যাঁর মুখ দিয়ে কথা সরে না, যিনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না, তিনি ছাত্রদের কী করে আঁকা শেখাবেন? জয়নুল আবেদিন জবাব দিয়েছিলেন, ‘কিছু না হোক, পরিবেশ তৈরি হবে।’ জবাবটা যে শতভাগ সত্যি, আমরা যাঁরা আর্টস্কুলে ছিলাম, তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছি।
বৃত্তি নিয়ে জাপান গেলেন কিবরিয়া সাহেব। বছর তিনেক বোধ হয় ছিলেন। ফিরে এলেন নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে। চমৎকার লিথোগ্রাফির কাজ আমরা দেখলাম। দেখলাম, নিজেকে বদলেছেন ছবির আঙ্গিকেও। বিষয়বস্তু উধাও ক্যানভাস থেকে। ফর্ম, স্পেস, টেক্সচার নিয়ে এক নতুন মাত্রার ছবি। কথা কম বলেন, ভেতরে ভেতরে একজন রসিক ব্যক্তি। তাঁর সান্নিধ্য আমরা উপভোগ করতাম। আর্টস্কুলের হোস্টেলে থাকতেন। বারান্দায় চেয়ার পেতে আড্ডা জমত। চা, চানাচুর, পনির চলত।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা হোস্টেলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। দৈবক্রমে কিবরিয়া সাহেব বেঁচে যান। ২৭ মার্চ সকালে হোস্টেল ছেড়ে কিবরিয়া সাহেব আমার বাসায়। আমি তখন আজিমপুরে থাকি। দরজা খুলে কিবরিয়া সাহেবকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। রক্তশূন্য একজন মৃত মানুষের মুখ যেন আমি প্রত্যক্ষ করছি। আমার সঙ্গেই ছিলেন সে সময়ের বিভীষিকাময় কটি দিন। আমি বাসা ছেড়ে অন্যত্র গিয়েছি, কিবরিয়া সাহেব আমার সঙ্গে। সেই একাত্তরেই নিঃসঙ্গতা কাটালেন কিবরিয়া সাহেব। নিঃসঙ্গ জীবনের একজনকে জীবনসঙ্গিনী করে নিলেন। গ্রাফিক ডিজাইনার আঞ্জুম কিবরিয়া, বড় ছেলে নাশরিদ ও ছোটজনকে নিয়ে ছিল সুখের সংসার। হাসপাতালে বারবার ডাকছেন ছেলেকে, ‘বাবু, আমাকে বসিয়ে দাও। বাবু, আমাকে শুইয়ে দাও।’ সবার স্নেহ, ভালোবাসা ও ভক্তি উপেক্ষা করে কিবরিয়া সাহেব চলে গেলেন। বাংলাদেশের শিল্পভুবন, সমগ্র সাংস্কৃতিক ভুবন আজ শোকাচ্ছন্ন, অন্ধকারাচ্ছন্ন।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger