জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি আবু জাফর শামসুদ্দীন

লেখক-চিন্তাবিদ আবু জাফর শামসুদ্দিন তৎকালীন ঢাকা জেলার কালীগঞ্জ থানার দক্ষিণবাগ গ্রামে এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু ১৯৩২ সালে। তিনি অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, মননশীল প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনি রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই হলো: পদ্মা মেঘনা যমুনা, প্রপঞ্চ, দেয়াল, রাজন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা, শেষ রাত্রির তারা প্রভৃতি। তিনি সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও একুশে পদক পান।

১৯৪৭-এর আগস্টে দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন জাফর ভাই— আবু জাফর শামসুদ্দীন। মুসলিম লীগ নয়, বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছিলেন যৌবনের শুরুতেই। তার আগে ঢাকায় থাকাকালে ‘শিখা’ গোষ্ঠীর ভাবধারাও প্রভাব বিস্তার করেছিল তাঁর ওপর। পাকিস্তানে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের জন্মলগ্নে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন তার সঙ্গেও। তবে, সরাসরি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হয়তো কোনো দিনই সেভাবে ছিলেন না, বিশেষ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। কিন্তু কোনো সময়ই রাজনৈতিক তথা সামাজিক দায়িত্বকে অবহেলা করেননি। সাধ্যমতো ভূমিকা রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের সময়ের কথাই বলি। দৈনিক সংবাদ-এ তাঁর নিয়মিত কলামে ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশের গতিধারার সমর্থন জোগাতে চাইত, তার বিরুদ্ধে তিনি যে আপসহীন অবস্থান নিয়েছিলেন, সে জন্য নিয়মিত হুমকি দেওয়া হতো তাঁকে। কিন্তু সে হুমকি কোনো দিন তাঁর সংকল্পে বা কাজে কোনো দোদুল্যমানতা সৃষ্টি করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক ধারার বিস্তার নিষ্কণ্টক হবে, চলার পথে প্রতিপক্ষের আঘাত আসবে না, এটা কোনো দিনই মনে করতেন না তিনি। এই প্রশ্নে তাঁর চিন্তা ছিল খুবই স্পষ্ট। আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের বাংলাদেশ শাখার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাবে স্বীকৃতি দিতে এতটুকুও ইতস্তত করেননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিশেষ করে মধ্য এশিয়া ঘুরে এসে তাঁর লেখায় সে দেশ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি একবারও।
পারস্পরিক সম্পর্ক যখন গভীর হয়ে উঠেছে, তখন একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বাকশালে শামিল হওয়ার আহ্বান নিয়ে খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস যেদিন আপনার কাছে গিয়েছিলেন, সেদিন ও রকম পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়েছিলেন কেন?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক, যে পদ্ধতিতে সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে যাওয়া হচ্ছিল, তা ছিল ভুল। আর কেন জানি মনে হচ্ছিল, যা তখন করা হচ্ছিল, তা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু না।’
জাফর ভাইয়ের সঙ্গে তখনকার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছিল এমন একসময়, যখন আরও বেশ কিছুদিন শুধু বেঁচে থাকাই নয়, সক্রিয়ভাবে বেঁচে থাকাটা দরকার ছিল আমাদের জন্যই।
তবে এই সময়টুকুর যেটুকু তাঁকে দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, বিশ্বাসের প্রয়োজনে জীবনে যেকোনো ঝুঁকি নিতে ইতস্তত না করাটা একজন বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। ‘সত্য মূল্য’ না দিয়ে শুধু সাহিত্য নয়, কোনো ক্ষেত্রেই খ্যাতি চুরি করে জনমনে স্থায়ী আসন লাভ করা যায় না। সাহিত্যিক হিসেবে আবু জাফর শামসুদ্দিন কতটুকু কালোত্তীর্ণ বলে বিবেচিত হবেন, তা নিয়ে নানা অভিমত ব্যক্ত করতে পারেন নানাজন। কিন্তু মানুষ আবু জাফর শামসুদ্দিন, সত্যনিষ্ঠ আবু জাফর শামসুদ্দিন যে অতুলনীয়, তা স্বীকার করতে সবাই বাধ্য হবেন বলে মনে করি আমি।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger