লাগামছাড়া অপরাধ গাছাড়া প্রশাসন

বেশ কিছুদিন হলো দেশজুড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে। অপরাধীদের বেপরোয়া বিচরণ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জনমনে। কিন্তু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচ্চবাচ্য ও মরিয়া চেষ্টা-সবই বিফলে যাচ্ছে। উপরন্তু সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে গাছাড়া ভাব দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও প্রকট।

অপরাধ-আতঙ্ককে সম্প্রতি আরো ভয়াবহ করে তুলেছে রাজনৈতিক সন্ত্রাস। বিভিন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থীদের নিজেদের মধ্যকার বিরোধে হানাহানির ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়েও অস্ত্রধারীরা চালিয়ে যাচ্ছে বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। এরই মধ্যে সংঘটিত লোমহর্ষক কয়েকটি হত্যা, ডাকাতিসহ নানা অপরাধ দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এর পাশাপাশি পারিবারিক খুন-খারাবি যোগ করেছে আতঙ্কের আরেক মাত্রা। শুধু রাজধানীতেই গত এক মাসে ঘটেছে এক ডজন চাঞ্চল্যকর অপরাধ। পুলিশের গোয়েন্দা শাখাসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলমান বাস্তবতা আর গোয়েন্দাদের গোপনীয় প্রতিবেদনে যা-ই বলা হোক না কেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দাবি করছেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অপরাধ নির্মূলে সরকার বদ্ধপরিকর। কিন্তু তাঁদের এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ মানুষকে খুব বেশি আশ্বস্ত করতে পারছে না। অনেকেরই ভাষ্য, অপরাধের মাত্রা আর ধরন কোন পর্যায় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে, সেটা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্ব দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে। সরকারের প্রথম বছরে আইনশৃঙ্খলা কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রের মহড়া, অপরাধীদের প্রকাশ্য তৎপরতা, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা চাঞ্চল্যকর অপরাধ প্রশ্নবিদ্ধ করছে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে। অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রশ্রয়, র‌্যাব-পুলিশের বিরোধ ও সমন্বয়হীনতায় কর্মকাণ্ডে শিথিলতা, চাঞ্চল্যকর অপরাধ ও মামলার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবসহ নানা ঘটনা অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সহায়ক হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন গতকাল শনিবারও সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, বেশির ভাগ অপরাধ হচ্ছে ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে। এর বাইরে যা কিছু ঘটছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা সুন্দরভাবে সামাল দিচ্ছে। সম্প্রতি সংঘটিত নানা অপরাধের আসামিদের দ্রুত সময়ে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুরেই কালের কণ্ঠকে গতকাল পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, খুন, ডাকাতির কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। যা ঘটছে এর বেশির ভাগই ব্যক্তিগত বিরোধের সূত্র ধরে। তাই সামাজিকভাবে এসব বিরোধ নিষ্পত্তি করা গেলে অপরাধ কমার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও কাজের চাপ কমে আসবে।
পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তাদের অনেকেই বলেছেন, ক্রসফায়ার ও গুপ্তহত্যা নিয়ে ধারাবাহিক সমালোচনার মুখে র‌্যাব এখন অনেকটাই সতর্কভাবে এবং ধীরে কাজ করছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রত্যাশিত পদোন্নতিসহ সুযোগ-সুবিধা না বাড়ায় পুলিশ বিভাগের অনেকের মধ্যেই এখন কর্ম-অনীহা স্পষ্ট। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে যথেষ্ট। গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিংয়ে বিশেষ এলাকার প্রাধান্য কোণঠাসা করে রেখেছে অনেক কর্মকর্তাকে। আবার সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সাহস দেওয়া হলেও পুলিশ কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবে পড়ে অনেক সময় অপরাধমূলক ঘটনায় সমঝোতার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো মনিটরিং করার কথা থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব না দেওয়ায় তদন্তকারীরাও দায়সারা জবাব নিয়ে হাজির হচ্ছেন ঊর্ধ্বতনদের কাছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় বড় বড় মামলা থেকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত আসামিদের ছাড় দেওয়ার ঘটনাও পুলিশকে তাদের কাজ থেকে পিছপা করছে। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেই এক ধরনের শৈথিল্যভাব অপরাধীদের বেপরোয়া করে তুলছে বলে অনেকের মত।
কিন্তু র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল সমন্বয়হীনতা ও কর্মশিথিলতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, নিয়মিত টহল ছাড়াও র‌্যাবের বিভিন্ন ইউনিট ছিনতাই, চাঁদাবাজির ঘটনা প্রতিরোধেও কাজ করছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমেই তারা কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বড় ধরনের অপরাধমূলক ঘটনায় র‌্যাব কার্যকর ভূমিকা রাখছে। জঙ্গি দমন ও চরমপন্থীবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি র‌্যাব অন্যান্য অপরাধী গ্রেপ্তারেও সফলতা পেয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন এবং একুশের বইমেলা নিয়ে রাজধানীতে পুলিশ বাহিনী ব্যতিব্যস্ত। এরই মধ্যে ঘটে চলেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর অপরাধ। গত এক মাসে রাজধানীতেই খুন হয়েছে ২৯ জন। এর মধ্যে তিনটি জোড়া খুন; যদিও ১৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ব্যক্তিগত কারণ বা বিরোধের জের ধরে, রাজনৈতিক কারণেও ঘটেছে দুটি। ডাকাতির ঘটনায় নিহত হয়েছে দুজন এবং ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে মারা গেছে একজন। অন্য হত্যাকাণ্ডগুলোর কারণ এবং অপরাধী শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
অনেকেই মনে করছে, অপরাধমূলক নানা ঘটনাকে পুলিশ ব্যক্তিপর্যায়ের বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় বড় ধরনের অপরাধেও পুলিশের দায়সারা মনোভাবের অভিযোগ রয়েছে, যার কারণে সার্বিক পরিস্থিতি অনেকটাই অস্থির হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক বা সামাজিক বন্ধন অনেক দুর্বল হয়ে পড়ছে বলেই খুনসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। মানসিক অস্থিরতা থেকে সামন্য কারণেই হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এটি অপরাধের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়কেও প্রকাশ করে। সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির মাধ্যমে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় প্রতিহত করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান বলেন, ‘পারিবারিক ও সামাজিক কারণে অনেকে হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। চরম মানসিক অস্থিরতা থেকে এ ধরনের অপরাধের সৃষ্টি। ঘটনার সময় হত্যাকারীর চেতনাবোধ লোপ পায়। মানুষের জন্য তাদের মনে ভালোবাসা থাকে না।’
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান সাদী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধের কাজে জড়িয়ে নিজেকে নিরাপদ বা ভালো মনে করলে অপরাধী ওই অপরাধ বারবার করে। অপরাধ-সহায়ক পরিবেশে মানসিক বিকাশ অল্প বয়সেই অপরাধপ্রবণতা তৈরি করতে পারে। বর্তমানে যুবসমাজের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা বেশি। অস্থিরতার কারণে হত্যাকে কেউ বড় অপরাধ বলে ভাবতে পারে না। তাই সামান্য কারণেই হত্যাকাণ্ড ঘটছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে অপরাধের কৌশল পাল্টায়। তবে সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির মাধ্যমে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় প্রতিহত করা সম্ভব।’
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger