জামায়াতের সামনে তিন সংকট

গামী দিনে দলের রাজনীতির জন্য গুরুতর সংকট সৃষ্টি করতে পারে-এমন তিনটি ইস্যুর সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ইস্যু তিনটির একটি দলের অভ্যন্তরীণ, বাকি দুটি রাজনৈতিক। অভ্যন্তরীণ সংকটের সমাধানের ব্যাপারে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা মোটামুটি আস্থাশীল হলেও বাকি দুই সম্ভাব্য সংকট নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠায় আছেন তাঁরা।

সূত্রের দাবি, এ বিষয়ে দলের অবস্থান ঠিক করতে গতকাল শুক্রবার ডাকা কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার বিশেষ অধিবেশনে আলোচনা হওয়ার কথা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিন সংকটের অন্যতম হচ্ছে নির্বাচন কমিশন থেকে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে দায়ের করা একটি রিট মামলা। আদালতের কার্যতালিকা অনুযায়ী আগামীকাল রবিবার এ মামলার শুনানি হওয়ার কথা। মামলার ফলাফল প্রতিকূলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করে জামায়াতের নীতি-নির্ধারণীপর্যায়ের নেতারা খুব চিন্তায় পড়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য মতে, বাকি দুই সংকটের একটি হচ্ছে দলের নতুন ‘আমির’ নির্বাচন। অন্যটি হচ্ছে সারা দেশে অনুষ্ঠিত
পৌরসভা নির্বাচনের আগে ও পরে স্থানীয়পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের ছন্দপতনে জামায়াতের ভবিষ্যৎ রাজনীতি।
বিষয় তিনটির উল্লেখ করে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম দাবি করেন, কোনোটিই জামায়াতের রাজনীতির জন্য সংকট সৃষ্টি করবে না।
নিবন্ধন বাতিলের আশঙ্কা : জামায়াতে ইসলামীর নাম ও এর গঠনতন্ত্রের অন্তত ছয়টি ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে দলটির নিবন্ধন বাতিল চেয়ে ২০০৮ সালে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। মামলাটি বিচারাধীন রেখেই জামায়াত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। নিবন্ধন বাতিলের আরজি করে দায়ের করা ওই মামলাটি আবার সক্রিয় হয়েছে।
জামায়াতের শীর্ষপর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা এ মামলায় হেরে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। তবে তাঁরা বিষয়টিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলেই মনে করছেন। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সম্প্রতি উচ্চ আদালতের রায়ে বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃস্থাপন ও সে আলোকে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এমনিতেই বিলুপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট না হওয়ায় ধর্মভিত্তিক দলগুলো এখনো প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের নাম ও এর গঠনতন্ত্রের ধারার সংশোধিত সংবিধানের সঙ্গে বিরোধ থাকলে আদালত দলটির নিবন্ধন বাতিলের রায় দিতে পারেন।
এ টি এম আজহারুল ইসলামও মনে করেন, বাহাত্তরের সংবিধানকে বেইজ ধরলে কোর্ট নিবন্ধন বাতিলের রায় দিতেও পারেন। তবে তিনি জানান, নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করলে তাঁরা আইনি প্রক্রিয়ায় যাবেন। তিনি বলেন, নিবন্ধন বাতিল মানে তো দল বাতিল নয়। বিষয়টি এই নয় যে এর মাধ্যমে দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে।
মামলার বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে এ মামলার কুশলী ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক ও ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল। কৃত্রিমভাবে কোনো আইন তৈরি করে জামায়াতকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা কল্যাণকর হবে না।’
সময় চাইবে জামায়াত : নিবন্ধন বাতিলের আবেদন করা মামলাটির শুনানি পেছাতে জামায়াতের পক্ষ থেকে আবেদন করা হবে। সহসা যাতে মামলার নিষ্পত্তি না হয়, সে জন্য তাঁরা আইনজীবীর মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করার কৌশল নিতে পারেন। এক প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে দলের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘এটা এমন ইস্যু নয় যে এখনই শেষ করতে হবে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হাজার হাজার মামলা আছে। আমরা সময় চাইব।’
জানা গেছে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে মামলাটির নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, আগামী মার্চের শেষ নাগাদ মামলার রায় হয়ে যেতে পারে।
নতুন আমির নির্বাচন : ২০১২ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর দায়িত্ব পালনে অক্ষমতার মেয়াদ ছয় মাসের বেশি হওয়ায় দলের একটি অংশে নানা রকম চিন্তাভাবনা চলছে। এ অংশটি বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমিরের অন্তর্বর্তীকালীন শেষে নতুন আমির নির্বাচনের পক্ষে।
মতিউর রহমান নিজামী প্রথমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার একটি মামলায় ও পরে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন সাত মাস আগে। গ্রেপ্তারের আগে তিনি নায়েবে আমির মকবুল আহমদকে ভারপ্রাপ্ত আমির নিয়োগ দিয়ে যান।
দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আগামী মে মাসে ভারপ্রাপ্ত আমিরের অন্তর্বর্তী সময় শেষ হবে। এ মেয়াদের পর বিশেষ কারণ না থাকলে নতুন আমির নির্বাচনের কথা উল্লেখ আছে।
নিজামীর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০১২ সালে অবশ্যই নতুন আমির নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু দলের ওই অংশটি গঠনতন্ত্রের ‘বিশেষ অবস্থার’ সুযোগ না নেওয়ার পক্ষে। তারা অতীতে গোলাম আযমের মতো মাওলানা নিজামীকে আমির পদে রেখে অন্তর্বর্তীকালীন আমিরের মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী করার পক্ষপাতী নয়।
বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির প্রথম ছয় মাস পার করার পর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অনুমোদন নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে আরো ছয় মাসের দায়িত্ব পেয়েছেন। এই মেয়াদের পরই নির্বাচন হওয়ার কথা। নতুন আমির নির্বাচনের পক্ষে থাকা অংশটি মনে করে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো একটি জটিল মামলায় আটক নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। দলের গতিশীল নেতৃত্বের জন্য এত সময় অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
কিন্তু জামায়াতের মূলধারা এই চিন্তার সঙ্গে একমত নয়। তারা মনে করে, বিচারের আগেই শীর্ষ নেতাদের সরিয়ে দেওয়া অমানবিক এবং আদালতের আগেই বিচারের শামিল বলে বিবেচিত হবে।
সূত্রে জানা গেছে, গতকাল অনুষ্ঠিত দলের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার বৈঠকের আলোচনায় ভারপ্রাপ্ত আমিরের বর্ধিত ছয় মাসের মেয়াদ অনুমোদন ও এই মেয়াদ শেষে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের প্রসঙ্গটি ছিল। এ বিষয়ে শুরার সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।
বৈঠকের আগে বিষয়টির উল্লেখ করে বক্তব্য জানতে চাইলে এ টি এম আজহার বলেন, ‘২০১২ সাল পর্যন্ত নেতৃত্ব নিয়ে কোনো চিন্তার কারণ নেই। এ নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না।’
তিনি বলেন, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমিরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা হয় নির্বাচন, না হয় স্বাভাবিক মেয়াদ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্বের সময় বাড়াতে পারবে।
বিএনপির সঙ্গে ছন্দপতন : এবারের পৌরসভা নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কে বড় ছন্দপতন হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় তিক্ততারও সৃষ্টি হয়। পৌর নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি আগামীতে চারদলীয় জোটে জামায়াতকে কোণঠাসা করারও ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু জোটে বিভক্তি হতে পারে আশঙ্কা করে জামায়াতের নেতারা তা হজম করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন নেতা বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচনে আবারও প্রমাণ হলো জামায়াতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই এক। আমরা দেখেছি, যেসব পৌরসভায় জামায়াত প্রার্থীদের সম্ভাবনা ছিল, সেসব জায়গায় কোথাও আওয়ামী লীগ পক্ষ নিয়েছে বিএনপির, কোথাও বিএনপির পক্ষ নিয়েছে আওয়ামী লীগ।’
জামায়াত এবার ৪৩টি পৌরসভায় মেয়র ও সাড়ে তিন শ’ কাউন্সিলর প্রার্থী দিয়ে ছয়টি মেয়র ও ১১০টি কাউন্সিলর পদে জয় পেয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে ৪৩টি পৌরসভাতেই বিএনপির স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে জামায়াতের গোপনে-প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব ছিল।
বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, ‘এবারের পৌর নির্বাচন আমাদের জন্য উৎসাহের এবং সতর্কেরও।’
নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জামায়াতের বেশির ভাগ প্রার্থী হেরেছেন বিএনপি প্রার্থীর কাছে। বিশেষ করে জামায়াত প্রভাবিত এলাকা হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, সাতকানিয়া ও কক্সবাজারে এই ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, পৌর নির্বাচনের আগে থেকে বিএনপির বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা জামায়াতকে এড়িয়ে চলছেন। তাঁদের ভূমিকায় পৌর নির্বাচনে সমঝোতার লক্ষ্যে তিন দফা বৈঠক করেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। জামায়াতের প্রার্থিতা থাকার পরও পৌর নির্বাচনের এ ফলাফলে বিএনপিতে আÍবিশ্বাস জেগেছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে চারদলীয় জোটে জামায়াতের অবস্থান কী হবে তা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা চিন্তিত। জানা গেছে, গতকালের মজলিসে শুরার বৈঠকে এ বিষয়টিও আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল। তথ্য মতে, শুরার সদস্যরা কারো দিকে চেয়ে না থেকে দলের অবস্থান মজবুত করতে পরামর্শ দিয়েছেন।
পৌর নির্বাচনকে জামায়াত কিভাবে মূল্যায়ন করছে জানতে চাইলে দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি বলেন, ‘পুরো একটি বছর আমরা সরকারের কোপানলে ছিলাম। সে হিসেবে উৎসাহব্যঞ্জক।’
দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমদ বলেন, ‘তারা (সরকার) আমাদের মুছে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমরা ছয় মেয়র ও ১১০ কাউন্সিলর পেয়েছি।’ পৌর নির্বাচনে বিএনপির আÍবিশ্বাস জামায়াতকে জোটে কোণঠাসা করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় না সেটা ঘটবে।’
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger