বিমান থেকে জনতার ওপর বোমা

লিবিয়ায় বিক্ষোভ-সহিংসতা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চল সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারী ও বিদ্রোহী সেনাদের দখলে চলে গেছে। বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতেরা বিক্ষোভকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। এদিকে বিক্ষোভ দমনে ট্যাংক-যুদ্ধবিমানসহ সামরিক বহর মোতায়েন করেছেন দেশটির নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি। যুদ্ধবিমান থেকে বোমাও ফেলা হয়েছে বিক্ষোভকারীদের ওপর।

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে গাদ্দাফি বিক্ষোভকারীদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিজের সমর্থকদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। খবর এএফপি, রয়টার্স, বিবিসির। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে আল-জাজিরা টেলিভিশন জানায়, গত সোমবার রাতে ও গতকাল সকালে রাজধানী ত্রিপোলি ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হয়। এ ছাড়া হেলিকপ্টার ও ট্যাংক থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে।
ত্রিপোলির বাসিন্দা আবদেল মোহাম্মদ সালেহ একটি বিদেশি টেলিভিশনকে বলেন, যা ঘটছে তা অকল্পনীয়। যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে একের পর এক বোমা ফেলা হচ্ছে। অনেক মানুষ মারা গেছে।
পূর্বাঞ্চলীয় শহর আল-বায়দার এক বাসিন্দা টেলিফোনে রয়টার্সকে জানান, সোমবার রাতে গাদ্দাফি-সমর্থকদের নির্বিচার গুলিতে তাঁর ভাইসহ ২৬ জন নিহত হয়। এ ছাড়া ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে।
ওই শহরের আরেক বাসিন্দা মাহরি বলেন, ‘চাই বা না চাই, আমাদের এখন মরতেই হবে। এটা পরিষ্কার যে, আমাদের মরা-বাঁচায় তাদের কিছু যায়-আসে না। এটা গণহত্যা।’ শুধু ত্রিপোলি, বেনগাজি, আল-বায়দা নয়, দেশজুড়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলে পড়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও গাদ্দাফির সমর্থকেরা।
পূর্বাঞ্চলীয় তবরুক শহর থেকে রয়টার্সের এক সাংবাদিক জানান, ওই অঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর হ্যানি সাদ মারজা বলেন, ‘পুরো পূর্বাঞ্চল এখন গাদ্দাফির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখানে জনগণ ও সেনাবাহিনী হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।’
ফাসলুম জেলা থেকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ‘ভাড়াটে খুনিদের’ নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা নির্বিচারে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছুড়ছে। তাজুরা জেলা থেকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সেখানেও বন্দুকধারীরা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে।
ভারতে লিবিয়া দূতাবাস থেকে পদত্যাগকারী রাষ্ট্রদূত আল-এসাওয়ি জানান, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমা হামলা চালাতে সরকার যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে। এ ছাড়া বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার জন্য সরকার বিদেশি নাগরিকদের ভাড়া করছে।
এর আগে জাতিসংঘে নিয়োজিত লিবিয়ার উপরাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম দাব্বাসি জানান, গাদ্দাফি নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে গণহত্যা শুরু করেছেন।
তবে গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলামের দাবি, বিক্ষোভকারীদের ওপর নয়, বিদ্রোহী সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করেই যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেলা হয়েছে।
এদিকে, গতকাল স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন গাদ্দাফি। কোনো অবস্থাতেই পদত্যাগ করবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আমার দেশ। নিজের শেষ রক্তবিন্দু ঝরে পড়া না পর্যন্ত আমি লড়াই করে যাব। পিতৃপুরুষের এই মাটিতে আমি শহীদ হব।’
বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালাতে নিজের সমর্থকদের নির্দেশ দিয়ে গাদ্দাফি বলেন, ‘ওই ইঁদুরগুলোকে ধরে ফেল। রাস্তায় নেমে আস, তাদের যেখানে পাওয়া যায় সেখানেই গুঁড়িয়ে দাও।’
বিক্ষোভকারীরা ‘শয়তানের স্বার্থসিদ্ধির’ জন্যই কাজ করছে জানিয়ে গাদ্দাফি বলেন, যারা বিক্ষোভ করছে, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
ত্রিপোলিসহ গোটা লিবিয়ার অবস্থা গতকাল ছিল থমথমে। ত্রিপোলিতে তেমন কোনো বড় বিক্ষোভ হয়নি। তবে রাজপথে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে টহল দেয় পুলিশ ও সেনাবাহিনী। বেনগাজি পুরোপুরি বিদ্রোহীদের দখলে। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের পক্ষে যোগ দিয়েছেন।
ত্রিপোলির বাসিন্দা লিসা গোল্ডম্যান বলেন, ‘গাদ্দাফি যা খুশি তা-ই করতে পারেন, কোনো কিছুতেই তাঁর বাধে না। আমরা জানি, তিনি উন্মত্ত। তার পরও এটা খুবই দুঃখজনক যে, তিনি নিজের দেশের মানুষ মারছেন। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের কচুকাটা করছেন।’
গাদ্দাফি দাবি করেছেন, বিক্ষোভের মুখে তিনি দেশ ছেড়ে যাননি, রাজধানী ত্রিপোলিতেই আছেন। গাদ্দাফির এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, তিনি (গাদ্দাফি) দেশ ছাড়বেন না এবং পদত্যাগও করবেন না। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবেন। গত সোমবার বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলির ঘটনায় লিবিয়া সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
গাদ্দাফির ৪১ বছরের শাসনের অবসান ঘটাতে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তুমুল বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে লিবিয়ার মানুষ। এতে এ পর্যন্ত তিন শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। এর মধ্যে সোমবার রাজধানী ত্রিপোলিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিতে মারা যায় ৬০ জনের বেশি।
সোমবার রাত দুইটার দিকে হঠাৎ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখা যায় গাদ্দাফিকে। একটি ভাঙাচোরা ভবনের পাশ থেকে তিনি গাড়িতে গিয়ে উঠছেন। এ সময় বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মাথার ওপর একটি ছাতা ধরে আছেন। টেলিভিশন জানায়, গাদ্দাফিকে সরাসরি দেখানো হচ্ছে। এর আগে গুজব ছড়িয়ে পড়ে তিনি ভেনেজুয়েলায় পালিয়ে গেছেন।
টেলিভিশনে এক মিনিটের মতো কথা বলেন গাদ্দাফি। তিনি বলেন, ‘আমি গ্রিন স্কয়ারে তরুণদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।’ এই স্কয়ারটি ত্রিপোলির উপকণ্ঠেই অবস্থিত। সেখানে ওই দিন বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়।
গাদ্দাফি আরও বলেন, ‘এ কথা প্রমাণ করার জন্যই এসেছি যে আমি ত্রিপোলিতেই আছি, ভেনেজুয়েলায় নয়।’
গাদ্দাফির অন্যতম শীর্ষ সহযোগী নূরি আল-মিসমারি প্যারিসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গাদ্দাফি ক্ষমতা থেকে সরেও দাঁড়াবেন না, দেশও ছাড়বেন না। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবেন।
এদিকে হাজার হাজার বিদেশি ত্রিপোলি ছাড়ার চেষ্টা করছে। দেশটির বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাজার হাজার চীনা নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে লিবিয়া সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চীন।
তুরস্ক তাদের প্রায় তিন হাজার নাগরিককে সরিয়ে নিতে লিবিয়ার বন্দরনগর বেনগাজিতে তিনটি জাহাজ পাঠিয়েছে। ইতিমধ্যে বিমানে করে তারা প্রায় এক হাজার জনকে দেশে নিয়ে গেছে। গতকাল ফ্রান্স তার নাগরিকদের সরিয়ে নিতে একটি বিমান পাঠায়। কিন্তু সেটি ত্রিপোলিতে নামতে না পারায় মাল্টায় অবতরণ করে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের সরিয়ে আনতে বিমান পাঠাচ্ছে।
লিবিয়ার সাবেক উপনিবেশিক শাসক ইতালি বিমানবাহিনীর তিনটি সি-১৩০ বিমান পাঠাচ্ছে। প্রায় দেড় হাজার ইতালীয় লিবিয়ায় আছে।
মিসরের সঙ্গে লিবিয়ার সীমান্ত এখন বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে। এর আগে ওই সীমান্ত থেকে সীমান্তরক্ষীদের প্রত্যাহার করে নেয় লিবিয়া।
লিবিয়ায় অবস্থানকারী মিসরীয়রা ইতিমধ্যে লিবিয়া ছাড়তে শুরু করেছে। মিসর জানিয়েছে, নাগরিকদের দেশে নিয়ে আসতে তারা কমপক্ষে চারটি বিমান পাঠাচ্ছে।
আল-জাজিরা টেলিভিশন জানায়, বিক্ষোভকারীদের ওপর শক্তি প্রয়োগের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন দেশটির বিচারমন্ত্রী মুস্তাফা আবদুল জলিল। তিনি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ এবং জাতিসংঘ ও আরব লিগে নিযুক্ত লিবিয়ার কূটনীতিকেরা পদত্যাগ করে বিক্ষোভকারীদের পক্ষ নিয়েছেন।
গত সোমবার টেলিফোনে গাদ্দাফির সঙ্গে কথা বলেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। এরপর তিনি জানান, লিবিয়া-পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য মঙ্গলবার নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। মুন বলেন, ‘আমি তাঁকে (গাদ্দাফি) বলেছি, সভা-সমাবেশ, বাকস্বাধীনতা এবং মানবাধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।’
জাতিসংঘের মানবাধিকারের প্রধান নাভি পিল্লাই বলেছেন, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেই গণ্য হবে।
লিবিয়া-পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল কায়রোতে জরুরি বৈঠকে বসেন আরব লিগের কূটনীতিকেরা। পরে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, লিবিয়ার সরকার বিক্ষোভকারীদের দাবি পূরণ না করা পর্যন্ত লিবিয়াকে সংস্থার বৈঠকে অংশ নিতে দেওয়া হবে না।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলির ঘটনায় লিবিয়া কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘লিবিয়া সরকারের উচিত দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের অধিকারসহ সর্বজনীন অধিকারের প্রতি সম্মান জানানো। অন্যায় রক্তপাত এখনই বন্ধ করার সময়।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মন্ত্রীরা এক বিবৃতিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়নের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger