নিশ্চিত প্রাথমিক শিক্ষা by হাসান আজিজুল হক

বাংলাদেশের বয়স চলিস্নশ বছর হতে যাচ্ছে। এখানে দাঁড়িয়ে আরো দশ বছর পরের চেহারা দেখতে হলে একটু পেছনে ফিরে দেখা দরকার। দেশ ভাগের পর বাংলাদেশ হওয়ার আগে পর্যন্ত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের বয়স হয়েছিল ২৩ বছর। আমরা তাকে শিশুরাষ্ট্র বলতাম।

পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ গড়ব সেটা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল কথা। যদিও '৪৭ সাল থেকে '৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের প্রেক্ষাপট আমাদের ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি। এ কারণে আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি করেছিলাম দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, তা শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশে পরিণত করে। এরই ফলে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি হলো 'স্বাধীন' ও 'সার্বভৌম' রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এসব কথা ও শব্দগুলো তাবিজের মতো আমরা জীবন-যাপনে স্থান করে নিয়েছি। কিন্তু স্বাধীন এই রাষ্ট্রটির বয়সও পাকিস্তান রাষ্ট্রের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হতে চলেছে। তাই আমি এই রাষ্ট্রকে শিশুরাষ্ট্র বলতে রাজি নই।

চলিস্নশ বছর হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ ঠিক কী ধরনের রাষ্ট্র হবে, তার মোটামুটি একটা রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই জায়গা থেকে দাঁড়িয়েই তো পঞ্চাশ বছরের হিসাব_বাংলাদেশ কেমন দাঁড়াবে তার হিসাব-নিকাশ করা আমাদের জন্য আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ বছরে পেঁৗছাতে আর মাত্র দশ বছর বাকি আছে। চলিস্নশ বছর তো হয়েই গেছে প্রায়। তাহলে পঞ্চাশ বছরে কী দাঁড়াবে তার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ইতোমধ্যেই দাঁড়িয়েই গেছে। কী দাঁড়িয়েছে? কী দেখছি এখন? এই খান থেকেই তো আন্দাজ করতে হবে এক-চতুর্থাংশ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ কোথায় পেঁৗছাবে?

১৯৭১ সালে তৈরি হওয়া রূপরেখাটি সামনে রেখে ২০১১ সালে এসব বিষয়ে কথা বলার সময় এসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রের গতিমুখ পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার কারণে সাগরে পেঁৗছতে পারেনি বাংলার জনগণ_আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে যা বলুক, প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক হওয়ার কথা। আমি সবাইকে বলি, আপনারা সবাই একবার সরেজমিনে গিয়ে দেখে আসুন না, কেমন করে টিকে আছে এই শিক্ষাব্যবস্থাটি। ব্যক্তিগতভাবে, এনজিও বা অন্যান্য কোনো প্রতিষ্ঠান এই উদ্যোগ নেয়ার আগে রাষ্ট্রকেই নিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব। শুধু দায়িত্ব নিলে হবে না, কার্যকরও করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য থেকে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে অক্ষরজ্ঞান দেবেন বা অক্ষর চেনানো শিক্ষাব্যবস্থার কাজ নয়। আবার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, ফ্রি করে দেয়া, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য দেয়া খুব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সামাজিক কাঠামোটি যদি ওই রকম করতে না পারা যায়, তাহলে গোড়াতেই ওই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে। আর দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই নিরক্ষর বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরক্ষরতা দূর করার কর্মসূচি গ্রহণ করলেও চতুর্থ শ্রেণীতে ওঠার আগেই প্রায় ৮০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী ঝরে যায়। কারণ, বর্তমান বাংলাদেশে যে বাস্তব সমাজ কাঠামো রয়েছে, তা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের অনুকূলে নয়। আর অন্যান্য শিক্ষাব্যবস্থার কথা না-ই বললাম। এ রকম সামাজিক কাঠামোর মধ্যে কিভাবে সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করা যায়, সে ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচনের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন না করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের ভেতর এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর যে বিন্যাস রয়েছে, তা পুনঃবিন্যাস করতে হবে। নতুবা সব ধরনের উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে। এই ধারাবাহিকতা উচ্চশিক্ষার কাঠামোতে একইভাবে বিন্যাস করতে হবে।

আমি সাধারণত যেভাবে কথা বলি, তাতে সাধারণ মানুষ আমাকে নিরাশাবাদী বলতে চাইবে। আমি নিরাশাবাদী নই, ছিদ্রান্বেষী সমালোচকও নই। তবে আমি বাস্তবকে স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে চাই এবং অন্যদেরকেও দেখতে বলি। এই কথায় যেন কোনো পক্ষপাত না ঘটে, সত্যকে যেন ঠিক সত্য বলে দেখাই এই আমি কামনা করি। নিজেকে বা অপরকে স্তোক বাক্য শোনালে তাতে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না। আশাবাদের ঢাক বাজালেও নির্মম কঠিন রাস্তাগুলোও তো উঠে যাবে না। এই চলিস্নশ বছরে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছেন, রাষ্ট্র চালিয়েছেন তাদের কথা একরকম হবে। আর আমরা যারা সেই রাষ্ট্রে বসবাস করছি_১৫ কোটি মানুষ_অনেক শ্রেণীতে ভাগ হয়ে, অনেক রকম স্বার্থের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে জীবন যাপন করেছি আর করছি, এখানে তাদের কথা অন্যরকম হবেই। নানা রকম হবেই। যারা ক্ষমতা শাসনে অধিষ্ঠিত আছেন, তারা তাদের সাফল্যের কথাই বড় করে তুলে ধরতে চাইবেন। আমাদের দেশে গণতন্ত্র এখনো সেই পর্যায়ে ওঠেনি যে, জনগণ জবাবদিহিতে শাসকদের বাধ্য করতে পারে। সে জন্য ব্যর্থতা ঢাকা দিয়ে সাফল্যের পালস্নাটা ভারী করে দেখলে সেটা কি অাঁটকানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এই রাষ্ট্রে যেসব শ্রেণী উচ্চে অবস্থিত তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের সুবিধা, আইনের সুবিধা, নানাবিধ স্বার্থের সুবিধা আদায় করে নিতে পারছেন, তাদের কথাও তো আরেক রকম হবে। আমরা যারা উচ্চবিত্তভুক্ত নই, সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্তও নই; অথচ বাধ্যতামূলকভাবে দৈহিক ও মানসিক শ্রম দেয়া থেকে মোটামুটি অব্যাহতি পেয়েছি, কোনো রকমে টিকে আছি, মাঝারি জায়গায় আছি, কোনো রকমে কিছু কাজ, কিছু চাকরি, কিছু ব্যবসা, সন্তান-সন্ততির লেখাপড়া ইত্যাদি ব্যবস্থা করে নিতে পেরেছি তাদের কথাও আরেক রকম দাঁড়াবে। তাহলে রাষ্ট্রের ১৫ কোটি মানুষের জায়গা থেকে কোন কষ্টিপাথরে ঘষলে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কথা, সার্থকতার কথা ঠিকমতো ধরা পড়বে? সেটা তো আগে ঠিক করতে হবে। কাজেই আর দশ বছর পরে এটা কেমন দেশ দাঁড়াবে তার বিবরণ তো হাজার রকমই হয়ে যাবে। প্রশ্নটা হচ্ছে, এই প্রশ্নটা কাকে করা হচ্ছে এবং কে জবাব দিচ্ছে? আমার নিজের ধারণা সংখ্যাগরিষ্ঠের জায়গা থেকেই সম্ভবত একটি রাষ্ট্রের সার্থকতা বা ব্যর্থতার বিচার হওয়া উচিত। যদিও তা আমরা করতে পারি কি না বা পারলে সেটা আলাদা কথা। সাধারণত আমরা সবাই নিরপেক্ষতার ভান করি। দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত মানুষরাও অবশ্যই তা করি। তবু কঠিন বাস্তব ঠিক এক জায়গাতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে-কেউ তার কাছে যাবার চেষ্টা করলেই যেতে পারে। এই জায়গা থেকে গত চলিস্নশ বছরের উন্নয়ন হিসাব করা যেতে পারে। তার সর্বোচ্চ বেনিফিসিয়ারি কারা তার হিসাব করা যেতে পারে। মোটামুটি সুবিধা পেয়েছে এমন শ্রেণীগুলোরও হিসাব করা যেতে পারে। এমনকি প্রান্তিক সুবিধা যারা পেয়েছে, তাদেরও হিসাব করা সম্ভব। তাহলে উন্নতি বলতে আমাদের যাবতীয় অবকাঠামোর কথা বলা হোক, বিস্তার এবং প্রসারের কথা বলা হোক, আধুনিকতা এবং আধুনিকতার সুবিধার কথা বলা হোক, প্রযুক্তি ও প্রযুক্তির ব্যবহারে লাভালাভের কথা বলা হোক, অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-শিক্ষার নানা অনুপাতের বিষয় অনুসন্ধান করা হোক, সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যানগুলো খতিয়ে দেখা হোক_আর তার মুখোমুখি বাংলাদেশের ১৫কোটি মানুষকে উপস্থাপন করা হোক; তাহলে গত চলিস্নশ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কতটা এগোল, কতটা অর্জন করল; এবং পঞ্চাশ বছরে কতটা এগোবে, আর কতটা অর্জন করবে তার ভালো আন্দাজ পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে এর বেশি গভীর ও বিস্তারিত আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger