প্রতিক্রিয়া বনাম রাজনৈতিক প্রক্রিয়া by ড. ইশা মোহাম্মদ

স্থানীয় সরকার নিয়ে নানান কিসিমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে বহুকাল যাবৎ। কোন একটিতে কেউই স্থির থাকতে পারছে না। স্থানীয় সরকারকে স্বায়ত্তশাসন কিংবা স্বাধীনতা দেয়া হবে কিনা, দিলে তার চেহারা কেমন হবে- তা নিয়ে চিন্তা কিংবা দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

স্থানীয় সরকারের নির্বাচন এলেই এটি নিয়ে আবার পুরানো কথাগুলো ওঠে। কোন কোন রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক পরিচয়ে নির্বাচন পছন্দ করে। কোন কোন রাজনৈতিক দল অরাজনৈতিক নির্বাচন পছন্দ করে। এটি খুবই রহস্যময় মনে হয়। রাজনৈতিক দল কেন, কোন গোপনপ্রিয়তায় অরাজনৈতিক নির্বাচন পছন্দ করবে_ তা বোঝা যায় না। নির্বাচন কমিশন অরাজনৈতিক, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ। তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অরাজনৈতিক নির্বাচন পছন্দ করতেই পারে। আবার বাংলাদেশের আইনেও স্থানীয় নির্বাচনকে অরাজনৈতিক নির্বাচনের বিধি-বিধান আছে। বিষয়টি অনেকটা সোনার পাথরবাটির মত। কেননা, স্থানীয় নির্বাচন, তা সে পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ, যাই হোক না কেন, কোনদিনই অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নির্বাচন হবে না। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি মাত্রই রাজনৈতিক। কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের সম্পর্ক আছে। না থাকলে প্রকাশ্যে, গোপনে তারা সম্পর্ক রক্ষা করে। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে তারা সবাই প্রত্যক্ষভাবে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে অবস্থান নেয়। এরা এখন আর কেউ তাদের পছন্দের দলের প্রতীক না নিয়ে নির্বাচন করবে না। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত প্রতীক তালিকা থেকে একটা বেছে নেবে। ধরে নেয়া হয় যে, যেহেতু এরা স্থানীয় পর্যায়ে খুবই পরিচিত তাই যে-কোন প্রতীকই এদের জন্য একই প্রকার তাৎপর্য বহন করে। স্থানীয় পর্যায়ে প্রতীক প্রধান নয়, ব্যক্তিই প্রধান। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের ক্ষেত্রে আবার অসংখ্য স্বতন্ত্র প্রাথর্ী থাকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচিত হয়েও আসে। এসব বিষয়-আশয় দেখে-শুনে কি নির্দিষ্ট করে বলা যায় যে, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন প্রকৃত অর্থে অরাজনৈতিক? আসলে এটি খুবই নিম্নমানের প্রতারণা। বাংলাদেশের কোন নির্বাচনই আর অরাজনৈতিক হবে না। নির্বাচন কমিশন 'অরাজনৈতিক নির্বাচন' বলে সাধারণ মানুষকে ধাপ্পা দিচ্ছে। প্রাথর্ী নিজে নিজেকে অরাজনৈতিক বলে সাধারণ মানুষকে ধাপ্পা দিচ্ছে। যেখানে ব্যক্তি ও প্রত্যাশা রাজনৈতিক সেখানে অরাজনৈতিক নির্বাচনের কথা বলা মানেই প্রতারণা। আর তাদের এই নিকৃষ্ট পর্যায়ের গণপ্রতারণায় সরকার ও রাষ্ট্র নির্বিকারচিত্তে অংশগ্রহণ করছে। ভাবা যায়, বিশ্বায়নের এই যুগে, যেখানে মানবাধিকার নিয়ে ছোট-বড় কথার সমুদ্র সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে সাধারণ মানুষকে অরাজনৈতিক নির্বাচনের কথা বলে ভাঁওতা দিয়ে তাদের মানবাধিকার লংঘন করা হচ্ছে নির্বিকারচিত্তে।

হয়ত অনেকেই জানে না যে, বিশ্বের সব 'সভ্য' দেশে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন রাজনৈতিক। তবে ইউরোপ আমেরিকার রাজনৈতিক ও আমাদের রাজনৈতিকতা এক ও অভিন্ন নয়। তারপরও রাজনৈতিক নির্বাচন হলে আজকের দিনের বিবেচনায় মানবাধিকার সংরক্ষিত হয়। নইলে যারা রাজনৈতিক পরিচয়ে নির্বাচন করতে চায়, তাদের মানবাধিকার লংঘিত হয়।

প্রথম কথা হচ্ছে, নির্বাচন অরাজনৈতিক হবে কেন? অনেকেই প্রত্যাশা করেন, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক চাপে তাপে স্থানীয় 'স্বাধীনতা' নোংরা হয়ে যাবে। তাই কেন্দ্রীয় পর্যায়ের রাজনীতি যতই নোংরা ও অকল্যাণকর হোক না কেন, তার প্রভাব যেন স্থানীয় সুখ-শান্তিকে নষ্ট না করে দেয়। দ্বিতীয়, চিন্তা হচ্ছে বিভাজনে অপচয়ের চিন্তা। 'স্থান' যদি রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত হয়ে যায় তবে সামাজিক পরিবেশও বিভাজিত হবে। স্থানের আবহমান কালব্যাপী ঐক্য বিনষ্ট হবে। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নক্ষেত্রে যেটি দেখা গেছে। বিরোধী দলের সাংসদের এলাকায় উন্নয়ন চোখে দেখা যায় না। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন রাজনৈতিক হলে ঐ রকম বক্র দৃষ্টির কারণে কোন কোন এলাকা উন্নয়ন বর্জিত হতে পারে। এটি একটি ভয় এবং অভাবিত নয়। কিন্তু এই ভয় সনাতন, সমকালীন ও আধুনিক চিন্তার সাথে মেলে না।

বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্যে প্রথম প্রয়োজন প্রতিক্রিয়া তথা মৌলবাদকে ধ্বংস করা। রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই স্থানীয় পর্যায়ের 'প্রতিক্রিয়াকে' তৃণমূল থেকে নির্মূল করা সম্ভব। বাংলাদেশে মৌলবাদ কেন্দ্রে প্রবল নয় কিন্তু প্রতন্তে প্রবল। কিন্তু মৌলবাদকে সরকার ইচ্ছামত পিটিয়ে দেশ ছাড়া করতে পারবে না। দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ধীরে সুস্থে প্রত্যন্ত থেকে প্রতিক্রিয়া তথা মৌলবাদকে উচ্ছেদ করা সম্ভব। তাই এখন যখন সুযোগ আছে, তখন প্রয়োজন হল, পৌর ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সবকটি নির্বাচনকে 'রাজনৈতিক' করা।

প্রথম বাধা আসবে নির্বাচন কমিশন থেকে তারা আইন মোতাবেক চলতে চাইবে। তাই প্রথম প্রয়োজন আইনটাকে সংশোধন। আইন সংশোধন করাও অসম্ভব হবে না, যদি হাইকোর্টে একটা মামলা ঠুকে দেয়া যায়, তবে হয়ত একটা পরিত্রাণ সূত্র পাওয়া যায়। সংসদে আইন পাস করেও স্থানীয় নির্বাচনকে রাজনৈতিক করা যায়। কিন্তু হাইকোর্টে মামলা কে করবে? আইন পাসইবা কে করবে? এ গুরুদায়িত্ব মহাজোট সরকার, তথা আওয়ামী লীগকেই করতে হবে। সংসদে তাদের যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। দেশ ও জাতির কল্যাণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে রাজনৈতিক করার জন্যে যে কোন পদক্ষেপই নেয়া যায়। তবে প্রবল বাধা আসবে বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে। এই ভয়ে তারা রাজনৈতিক নির্বাচনে প্রবল বাধা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু তাই বলে ভয় পেলে চলবে না। মহাজোটের হাতে অনেক সময় নেই। সময় কম, কাজ বেশি। এখনই এখনকার কাজটা করা দরকার। আশা করি জাতীয় নেতৃত্ব বিষয়টি বুঝবে এবং জাতিকে 'প্রতিক্রিয়া'মুক্ত করার জন্যে স্থানীয় নির্বাচনকে রাজনৈতিক করবে।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger