নাট্যকার আতিকুল হক চৌধুরীর জন্য শুভাশীর্বাদ by খান সারওয়ার মুরশিদ

দেশের প্রখ্যাত নাট্যকার, সংস্কৃতিজগতে বিশেষ করে মিডিয়ার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল তারকা, আমার পরম স্নেহভাজন আতিকুল হক চৌধুরী ৮০ বছরে পদার্পণ করেছেন_এ কথা ভাবতে আমার বিশেষ আনন্দ হচ্ছে বৈকি। খুশি লাগছে ওর সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ধরে সেই পঞ্চাশের দশকে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতার সেই সুন্দর দিনগুলোর দিকে আজ আবার নতুন করে তাকাতে পারছি বলে।
রমনার সবুজ ছড়িয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পুরনো বিল্ডিংটা আর্টস বিল্ডিং মেডিক্যাল কলেজের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। লম্বা লাইব্রেরি ঘর, করিডর, সিঁড়ি। সামনে মাঠ। আমগাছ। মধুর ক্যান্টিন।
বই হাতে কত ছাত্রছাত্রীর মধুর কলবর। টার্নার, মুনীর চৌধুরী, আবু রুশদ, মতিন উদ্দিন সেদিনের আরো কত শিক্ষক বন্ধুরা আমার! তখন আমরা এখনকার মতো এত জটিল ও বিষাক্ত পৃথিবীতে বোধ করি বসবাস করতাম না। এখন পৃথিবী কত বদলেছে। মানুষ বদলেছে। তবে এই কয়েক যুগে আকাশের রং বদলায়নি। পাতাবাহারের হলুদ কালো ছিটে রং বদলায়নি। কৃষ্ণচূড়ার লাল রং বদলায়নি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গেটের সামনের রাস্তায় বড় বড় সেই কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো আর আগের মতো দাঁড়িয়ে নেই। সেদিনের অনেক কিছুই আজ আর নেই। কিন্তু স্মৃতিগুলো অমলিন। কী একটা অপার শান্তির সচ্ছলতার মাঝে আমরা বসবাস করতাম। চাহিদা ছিল কম। সুযোগ-সুবিধা আর প্রাপ্তির সুযোগও ছিল কম।
কিন্তু সম্ভাবনা ছিল। মেধা ও মনন বিকাশের সম্ভাবনা। এখনো যেন স্পষ্ট দেখতে পাই পুরনো আর্টস বিল্ডিংয়ে ইংরেজি সাবসিডিয়ারি ক্লাসে ডান দিকের বেঞ্চে একটি সুদর্শন ছেলে বসে আছে। কালো চশমা চোখে। আমি ইংরেজি কবিতা পড়াচ্ছি। কিটস্। বায়রন। শেলি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ।
ছেলেটি ক্লাসের মধ্যে কোনো কথা বলছে না। কানে কানেও না। বড় বড় চোখ তুলে গভীর মনোযোগ দিয়ে ক্লাসে আমার কথা শুনছে। খাতায় হয়তো টুকটাক লিখছেও বা। ক্লাসের বাইরে এই ছেলেটির সঙ্গে আমার কথাবার্তা যে হতো না তা নয়। হতো। তবে কম। মনে আছে, আমাকে একদিন অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ও জিজ্ঞেস করেছিল, 'স্যার ঙফব ঃড় রসসড়ৎধষরঃু-তে ডড়ৎফংড়িৎঃয যে ঈবষবংঃরধষ ষরমযঃ সবধহ করেছেন, আসলে এটা কী খরমযঃ?' আমি বোধ করি বলতে চেয়েছিলাম, 'এই আলো আসলে খরমযঃ ঙভ ঞযব ঝড়ঁষ. খরমযঃ ঋৎড়স ঐবধাবহ, যা এই ধূলিধূসরিত পৃথিবীতে বসবাস করতে করতে আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় পবিত্র শিশুর মুখাবয়ব থেকে।'
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমার স্নেহময়ী অপূর্ব সুন্দরী মায়ের মুখে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যে আলো আমি দেখেছি, তা ছিল চিরন্তন মহিমায় অম্লান।
সেই জ্যোতির্ময় আলোর পথের দিকে তাকালে আজ মনে হয়, একটি আলোর রেখা যেন চলে গেছে কোথায় কত দূরে।
পঞ্চাশের দশকে আমার বেশ কয়েকজন ছাত্রের মতো সেদিনের আতিকের মধ্যেও কোথায় যেন একটা আলো দেখেছিলাম। সেই আলোই উজ্জ্বল হতে হতে ওর সামগ্রিক জীবনকে যে আলোকিত করতে সক্ষম হয়েছে, এটা একজন শিক্ষক হিসেবে অবশ্যই আজ আমার কাছে বড় প্রাপ্তি। পঞ্চাশের দশকের আমার ছাত্র আতিকুল হক চৌধুরী আজ দেশের এক বরেণ্য নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব_এটা অবশ্যই আমার কাছে, আমাদের সবার কাছেই একটি সুসংবাদ।
আতিকুল হক চৌধুরীর নাট্যজীবন বোধ করি শুরু সেই ষাটের দশকে বেতারে। তারপর একটানা টেলিভিশনে, এখন পর্যন্ত। একদম নড়াচড়া নেই। আমার ছাত্রদের মধ্যে আতিকুল হক চৌধুরীই বোধ হয় এখনো গণমাধ্যমে একটানা চাকরিরত। চাকরি থেকে অবসর নেয়নি। নিজেকে গুটিয়ে রাখেনি কোনো কর্মকাণ্ড থেকে। আতিক সক্রিয়। ব্যাপকভাবে সক্রিয়। একেবারে যেন এঁটেসেঁটে বসে আছে তার নিজ স্থানে। নাট্যকার ও নাট্যশিক্ষক আতিকুল হক চৌধুরী, মিডিয়াব্যক্তিত্ব আতিকুল হক চৌধুরী একজন সজ্জন, নিরহংকার, সদা হাস্যময়, শিক্ষকের কাছে এখনো সদা অবনত আতিকুল হক চৌধুরী_কোনটা যে তার বড় পরিচয়, তা কখনো পরিমাপ করে দেখিনি।
ভাবতে অবাক লাগে, দীর্ঘ নাট্যজীবনে আতিক রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তলস্তয়ের এত সব গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে তার সফল প্রযোজনা করার দুঃসাহস অর্জন করল কোথা থেকে, কী করে? নিজেই বা এত কালজয়ী সাহসী নাটক লিখল কিভাবে? সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা পরিহার করে যে মানুষটি নানা প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যে এখনো একজন আধুনিক মানুষ, একজন মুক্তচিন্তার মানুষ, প্রগতিশীল মানুষ; যে সুরুচি ও নান্দনিকতার সঙ্গে কোনো আপস করেনি সারা জীবনে, তার শুভ জন্মদিনে নাট্যপ্রাণ আতিকুল হক চৌধুরীর ৮০ বছরে পদার্পণে, তার শিক্ষক হিসেবে আমার সবটুকু আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা রইল ওর জন্য। ঊষার শুকতারা আজীবন ওকে সব আঁধারের মধ্যে সত্যের পথে ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করুক_এই প্রার্থনা।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger