শিল্পশিক্ষার আনন্দযজ্ঞ

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নতুনত্ব সৃষ্টি এবং মানসিক উৎকর্ষ সাধনে বহুমাত্রিক চিন্তার প্রয়োগের উদ্যোগ হিসেবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এবং চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে চলছে শিল্পশিক্ষার এক আনন্দযজ্ঞ। ঢাকা-শান্তিনিকেতন শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের (২০১০-২০১১) অংশ হিসেবে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে সপ্তাহব্যাপী চিত্রকলার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হলো।

দুই বাংলার চারুশিল্পের প্রসিদ্ধ শিক্ষক ও শিল্পীদের সমাগম ঘটেছে বাংলাদেশে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ণ, ভাস্কর্য, ছাপচিত্র, কারুশিল্প, মৃৎশিল্প—এই পাঁচটি বিভাগ মিলে এ আয়োজন। ২০১০ সালের শেষ দিকে নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দুজন শিক্ষক বিশ্বভারতীতে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কার্যক্রম শুরু করেছেন। পরে শান্তিনিকেতন থেকে ১২ জন শিক্ষক-শিল্পী এ দেশে এসেছেন। গত ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পী এবং চারুকলা অনুষদের শিক্ষকদের সমন্বয়ে শুরু হয়েছিল দুই দিনের একটি কর্মশালা। ভারতীয় শিল্পের পুরোধা কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ এই কর্মশালা উদ্বোধন করেন একটি ক্যানভাসে ছবি এঁকে। শুধু ছবি আঁকা নয়, ছিল শিল্পবিষয়ক নানা মতবিনিময়, সেমিনার এবং মুক্ত আলোচনা। প্রথম দুই দিন ভারতীয় শিল্পী এবং এ দেশের শিল্পীদের কাজ দেখার সুযোগ ঘটেছে ছাত্রছাত্রীদের। পরবর্তী চার দিন ভারতীয় শিল্পীরা বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের শিল্পকর্ম-শিল্পভাবনা বিনিময় করেছেন। সেমিনারে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা, সচিত্র উপস্থাপন ও প্রশ্নোত্তর পর্বও ছিল। এ ক্ষেত্রে কলা ভবন এবং নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা, বাংলাদেশের লোকশিল্প, বাংলাদেশের মূলধারার শিল্পকলা—এ রকম নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে প্রতিদিন। দুই দেশের শিল্পের তাত্ত্বিক বিষয়াবলির পর্যালোচনা নতুনভাবে উঠে এসেছে।
বিশ্বভারতীর কলা ভবনের অধ্যক্ষ পঙ্কজ পাঁওয়ার এই শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে নানা দেশের এ ধরনের কার্যক্রম রয়েছে। তবে এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তা বাড়ানোর ইচ্ছা রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক বিনিময় বেশি। এ ধরনের কার্যক্রমে বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গে ভাবনা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়; সম্ভব হয় প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতাকে দূর করা।
গতানুগতিক ধারার বাইরে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা-চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শান্তিনিকেতন। পাশ্চাত্যের শিল্প-শিক্ষাকে গ্রহণ না করে নিজস্ব সমৃদ্ধ কৃষ্টি-শিল্প-সংস্কৃতির বৈভবকে আত্তীকরণ করেছে শান্তিনিকেতন। পঙ্কজ পাঁওয়ার মনে করেন, শিল্পের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কারণেই সাধারণের চেয়ে আলাদা হয় শিল্পীরা। তার কাজ মানুষের জীবনকে করে তোলে আরও অনুভূতিশীল ও আনন্দময়। বাংলাদেশের শিল্পীদের শিল্পের প্রতি আগ্রহ তীব্র। তাদের শিল্পকর্মে একটা তাগিদ অনুভব করা যায়। এ দেশের শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের উষ্ণ আতিথেয়তায় আমরা অভিভূত।
শিল্পী সঞ্চায়ন ঘোষ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগের প্রধান। তিনি বলেন, এই শিক্ষা কার্যক্রম কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা নির্ভর করছে এর পরিকল্পনার ওপর। শিল্প-শিক্ষায় শিক্ষার্থীর ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়; একটা পদ্ধতি শিখে তা অনুশীলন, চর্চা এবং নতুন কী সৃজন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শুধুই তাকে নানা পথের সন্ধান দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ভাবনাকে প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ না করে বিস্তৃত করে দিতে পারে।
ঢাকা-শান্তিনিকেতন শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের (২০১০-২০১১) প্রথম অংশে অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগের প্রধান শিল্পী ফরিদা জামান গিয়েছিলেন। তিনি জানালেন, পরবর্তী সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম নিয়ে তাঁরা ভাববেন। এ ছাড়া এই ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর্থিক সমস্যাও রয়েছে; এবার বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আর্থিক-সহায়তা সাময়িক সমাধান দিয়েছে।
আয়োজকদের একজন শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, শান্তিনিকেতনের সঙ্গে আমাদের শিক্ষা বিনিময়ের এই উদ্যোগ সফল হয়েছে শিল্পী রফিকুন নবীর মাধ্যমে। এখানে ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। এই কার্যক্রমে ব্যবহারিক বিষয়ের বাইরে তত্ত্বীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ভারতীয় শিল্পীদের নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং জাদুঘরে ভ্রমণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় শিল্পীরা হলেন—নন্দদুলাল মুখার্জি, দিলীপকুমার মিত্র, সুমিতাভ পাল, ঋষি বড়ুয়া, সলিল সাহানি, অর্পণ মুখার্জি, প্রবীরকুমার বিশ্বাস, প্রসুনকান্তি ভট্টাচার্য, সৌমিক নন্দী মজুমদার, পঙ্কজ পাঁওয়ার, সঞ্জয়কুমার মল্লিক, সঞ্চায়ন ঘোষ প্রমুখ।
শিল্প পৃথিবীকে অনুভব করার আবেগময় কৌশল। শিল্পী সর্বদা চেষ্টা করেন তাঁর স্পন্দিত অনুভূতিকে শিল্পকর্মে প্রকাশ করতে। বাংলার শিল্পকলার এই বিভাজন রাজনৈতিক; একই ভাষা, একই অনুভূতি, একই মানুষ, একই প্রকৃতির মেলবন্ধন এবং শিল্প ও ভাব বিনিময় আমাদের নিজেদের চিনতে সাহায্য করবে।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger