নারীদের উচ্চশিক্ষায় আশার প্রদীপ জ্বলল বাংলাদেশে

শিয়ার নারীদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। এই অঞ্চলের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতির জন্য যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে স্থাপন করা হয়েছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ)।

ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রীকে এই অঞ্চলের ‘আশার প্রদীপ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত আচার্য (চ্যান্সেলর) ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক শেরি ব্লেয়ারের হাতে সম্মাননা তুলে দেন। এ সময় অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষক, অতিথি ও পৃষ্ঠপোষকেরা আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। ২০০৮ সালের অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরতে ঢাকায় শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী সিম্পোজিয়াম। ‘এশিয়ার আরেক ভবিষ্যতের স্বপ্ন: পরিবর্তনের পথ ও চিন্তা’ শীর্ষক এই সিম্পোজিয়ামে বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিরা অংশ নিচ্ছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান ও স্বনামধন্য ব্যক্তিরা অর্থসহ সব ধরনের সহায়তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে উচ্চশিক্ষার মাইলফলক হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা করেন, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন শুধু বাংলাদেশেই নয়, এশিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলা ভাষায় দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার আহ্বান জানান।
শেরি ব্লেয়ার তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘গত এক দশকে অর্থনৈতিকভাবে এশিয়ার উত্থান হয়েছে। উন্নতির শিখরে উঠতে চাওয়া এশিয়ার ভিন্ন চেহারা রয়েছে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র ও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। দক্ষিণ এশিয়ায় মাতৃমৃত্যুর হার পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও তারা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত।’
দরিদ্র নারীদের বাইরে রেখে এশিয়া সামনের দিকে এগোতে পারবে না—এমন মন্তব্য করে শেরি ব্লেয়ার আশা প্রকাশ করেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় নারীদের মধ্য থেকে ভবিষ্যৎ এশিয়ার নেতৃত্ব গড়ে তুলবে।
‘উচ্চশিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের একটি উপায়’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মালয়েশিয়ার বর্তমান ফার্স্ট লেডি দাতিন পাদুকা সেরি রোসমাহ মনসুর। হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে ও আলাপের ঢংয়ে তিনি এশিয়ার অঞ্চলের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষা নারীদের বৈশ্বিক সমস্যা গভীরভাবে বুঝতে ও এসব সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে সহায়তা করে।
জাপানের সাবেক ফার্স্ট লেডি আকিও আবে বলেন, প্রতিবছর সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলেও বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছে। তবে নারীর উন্নতি না হলে কখনো একে পরিপূর্ণ সাফল্য বলা যাবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, জাপানের মতো উন্নত দেশেও এখন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি খাতের শীর্ষ পদে নারীদের অংশগ্রহণ কম।
দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন জাপানের সাবেক এই ফার্স্ট লেডি। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নারীদের ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখছে।
অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সরকার শিক্ষাকে ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানের বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে। এ বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য সরকার আগে ১০৪ একর জমি দিয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৭০ কোটি টাকা মূল্যে অধিগ্রহণ করা ৪৭ একর জমি কিনে দিয়েছে। ভবিষ্যতে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন শিক্ষামন্ত্রী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব অ্যাডভাইজারের সভাপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখতে এই বিশ্ববিদ্যালয় আগামী দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এশিয়ার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এখান থেকেই গড়ে উঠবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ও ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য কামাল আহমেদ বলেন, ‘ব্যক্তি হিসেবে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও সম্মিলিতভাবে কাজ করলে যে বড় কিছু করা যায়, তার বড় উদাহরণ এই বিশ্ববিদ্যালয়।’
উঁচুমানের উচ্চশিক্ষা ও সুনাগরিক গড়ে তুলতে এই বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে চলেছে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জ্যাক মেয়ার বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাত যে সম্মিলিতভাবে কাজ করে সফলতা আনতে পারে, তার উদাহরণ সৃষ্টি করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীলঙ্কার শিক্ষার্থীরা একটি ভিডিও তথ্যচিত্র ও নাটক পরিবেশন করেন। সিংহলি, তামিল ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্কের অবসানে তরুণ শিক্ষার্থীরা কীভাবে ভূমিকা রাখছে, তা একটি নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাগত যে বৈষম্য এবং দ্বন্দ্ব আছে, তা নিরসনে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের শিক্ষার্থীরা ভূমিকা রাখবেন বলে ঘোষণা দেন তাঁরা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে কুয়েতের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মহাসচিব লুলওয়া আল-মুল্লাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ‘ফ্রেন্ডস অব দ্য ইউনিভার্সিটি ২০১১’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
তৃতীয় পর্বে ‘সুশাসন, দারিদ্র্য, নিরাপত্তা ও পরিবেশে এশিয়ার আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। কানাডার ওয়েস্টার্ন ওন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট অমিত চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক সুগত বোস, ভারতভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (সিইসি) পরিচালক সুনীতা নারায়ণ ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান।
আজ শুক্রবার ও কাল শনিবার সিম্পোজিয়ামের বিভিন্ন পর্বে জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন কৃষি ও শিল্প বিপ্লব এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আসা গবেষক ও শিক্ষকেরা এতে বক্তব্য দেবেন।
উদ্যোক্তারা জানান, একটি পৃথক আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশের ৪৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। তাঁদের ৯৯ শতাংশই শতভাগ বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করছেন। সংশ্লিষ্ট আইনটিতে এখানে বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি করা বাধ্যতামূলক। তবে এখন স্থানীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। আগামী তিন বছরের মধ্যে এক হাজার ও সাত বছরের মধ্যে তিন হাজার ছাত্রীকে ভর্তি করানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর অর্ধেককে পুরোপুরি বৃত্তি দেওয়া হবে।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger