মূল্যস্ফীতির চাপে শেয়ারবাজারে টানাপোড়েন

দুনিয়াজুড়ে বাংলাদেশের নাম আরেকবার ছড়িয়ে পড়ল। তা সম্ভব হলো দেশের পুঁজিবাজারে বিরাট বিপর্যয়ের কারণে। এতে হয়তো খুশি হওয়ার কিছু নেই। তবে যেটা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের সচেতন করতে পারে সেটি হলো, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের এই উত্থান-পতন কিছু কিছু দেশে গভীর মনোযোগ কেড়েছে।

মনোযোগ কেড়েছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও ক্রেতাদের। তারা বাংলাদেশকে ও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এবার একটু ভিন্নভাবে পর্যালোচনা শুরু করেছে। আবার কেউ কেউ বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও প্রবণতার সঙ্গে নিজেদের শেয়ারবাজারকে মিলিয়ে দেখতে চাইছে। ফিলিপাইনের কথাই ধরা যাক। সেখানকার কোনো কোনো বিশ্লেষক বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ধস নামা থেকে সে দেশের কারবারি ও বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা নিতে বলছে, সতর্ক হতে বলছে। দেশটির প্রধান শেয়ারবাজার ফিলিপাইন স্টক এক্সচেঞ্জের মূল সূচক হলো পিএসই সূচক। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই সূচক চার হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে গেছে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে চলায় তা ইতিমধ্যে শেয়ারবাজারের ওপর চাপ তৈরি করেছে।
অবশ্য বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে তারা একটা দিক থেকে স্বস্তিতে রয়েছে। গত পাঁচ বছরের (২০০৬-১০) দুই বাজারের গতি-প্রবণতা পর্যালোচনা করে তারা দেখতে পায়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচক যত দ্রুত হারে ও যতটা বেড়েছে, পিএসই সূচক সেই হারে ও সেভাবে বাড়েনি।
ফিলিপাইনের বাজারের বিষয়টি যখন চলে এল, তখন আসলে এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোর সর্বশেষ প্রবণতাটার দিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে এখানে চলে আসছে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বস্তুত এই বছরের প্রথম তিন সপ্তাহে এশিয়ার প্রধান শেয়ারবাজারগুলোয় দুটি বিপরীতধর্মী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও চীনের শেয়ারবাজার যথাক্রমে ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে পড়ে গেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই পতনের মূলে রয়েছে মূল্যস্ফীতিজনিত আতঙ্ক।
এখানকার বিনিয়োগকারীরা এখন শেয়ার ও বন্ড বিক্রি করে দিয়ে দ্রুত মুনাফা তুলে নেওয়ার দিকেই মনোযোগী। তাঁরা এও মনে করছেন, এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাসময়ে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেনি বা করলেও তা খানিকটা ধীরে ধীরে।
যেমন—ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) গত মঙ্গলবার রেপো (কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দেয়) ও রিভার্স রেপোর (কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে যে সুদ দেওয়া হয়) হার বাড়িয়েছে। তবে সেখানকার অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, এই হার যতটা বাড়ানো হয়েছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ানো উচিত ছিল।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার ইকোনমিক টাইমসকে বলেছেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির মূলে রয়েছে দুই অঙ্কের খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার ও তেল-পণ্যের উচ্চমূল্য। একদিকে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো, অন্যদিকে মুদ্রার সরবরাহ কমানো—এ দুইয়ের মাধ্যমে এই মূল্যস্ফীতিকে প্রশমিত করতে হবে। রেপো ও রিভার্স রেপোর হার বাড়িয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।’
আরেক ধাপ বাড়িয়ে মন্তব্য করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক বিপুল মালাকার। তাঁর মতে, এই নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়ানোর কোনো প্রভাব বেড়ে চলা পণ্যমূল্যের ওপর পড়বে না। কেননা, মুদ্রাবাজারে উচ্চমাত্রায় ফাটকা চাহিদাই মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। তাই এই ফাটকা চাহিদার প্রশমন ঘটিয়ে এবং উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনতে হবে।
অথচ আরবিআইকে বলা হচ্ছে এশিয়ার সবচেয়ে আগ্রাসী কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যে কিনা গত বছরে ছয়বার বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী সুদের হার বাড়িয়েছে। আর জানুয়ারি মাসে রেপো ও রিভার্স হার যথাক্রমে সোয়া ছয় ও সোয়া পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ছয় ও সাড়ে পাঁচ শতাংশে উন্নীত করেছে।
বিপরীতে মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা দ্রুত মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক করেছে সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে। এটি আবার সে দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। তাই এ দুটি দেশের প্রধান শেয়ারবাজার আলোচ্য সময়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। সিউল স্টক এক্সচেঞ্জে তো একপর্যায়ে রেকর্ড উল্লম্ফন ঘটেছে। রয়টার্সের বিশ্লেষণে এমনটিই বলা হয়েছে।
সুতরাং, মূল্যস্ফীতির চাপে এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোয় এক ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। শুধু শেয়ারবাজারই নয়, মুদ্রাবাজারে বিশেষত বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় হারের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির চাপ আরেকটি অস্থিরতা তৈরি করেছে।
থাইল্যান্ডের বিহিত মুদ্রা বাথ ও ভারতের রুপির দরের বড় ধরনের পতন ঘটেছে। আর এটা ঘটছে যেহেতু এসব দেশের বিদেশি বিনিয়োগকারী ও কারবারিরা শেয়ার ও বন্ড বিক্রি করে দিচ্ছে এবং মার্কিন ডলার কিনছে। এমনকি থাইল্যান্ডে কিছু স্থানীয় স্বর্ণ আমদানিকারকও ডলার কিনতে শুরু করেছে। এই চাহিদা বৃদ্ধি ডলারের দর বাড়িয়ে স্থানীয় মুদ্রাকে স্বাভাবিকভাবেই চাপের মুখে ফেলছে। সিঙ্গাপুরের স্ট্রেট টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে (২৩ জানুয়ারি) এসব তথ্য দিয়ে আরও বলা হয়েছে, সম্ভবত এশিয়ার মধ্যে এখন একমাত্র তাইওয়ানেই বিদেশিরা শেয়ার ও বন্ড কিনছে।
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ: বাংলাদেশে শেয়ারবাজারের বিরাট দরপতন বা ধস যা-ই বলা হোক না কেন, এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতির একটা যোগসূত্র দাঁড় করানো যেতে পারে। যদিও বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে যে অবস্থায় গিয়েছিল, তা থেকে বিরাট পতনটা ছিল অনিবার্য। আর মূল্যস্ফীতি প্রশমনের জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতি এই পতনে দৃশ্যতই একটা ভূমিকা রেখেছে।
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মূল কথাই হলো মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে আনা। আর এটা কমিয়ে আনতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত সুদের হার বাড়ানোর দিকে যায়। এতে একদিকে ঋণ প্রবাহ কমে, অন্যদিকে মানুষজন আগের তুলনায় বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা করে একটু বাড়তি সুদ পাওয়ার জন্য। এতে শেয়ার ও বন্ড বাজার থেকে অর্থ প্রত্যাহার করার একটা প্রবণতা দেখা দেয়।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে (অক্টোবর, ২০১০ হিসাবে) বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর সরকারি লক্ষ্যমাত্রা হলো চলতি ২০১০-১১ অর্থবছর শেষে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখা। কাজেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি রুখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক থেকে করণীয় হলো সুদের হার বাড়ানো। সেই পদক্ষেপ হিসেবেই ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক খাতের বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) ও নগদ জমার হার (সিআরআর) বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর এতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ ছিল। কেননা, সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিতে যাচ্ছে।
এ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে মুদ্রাবাজার থেকে বাড়তি তারল্য তুলে নেওয়ার দিকে অগ্রসর হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসের তুলনায় ২০১০ সালের নভেম্বরে দেশে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশের বেশি। এতে বোঝা যায়, বাজারে যথেষ্ট অর্থ প্রবাহ ঘটেছে।
তবে আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়। মুদ্রা সরবরাহ এতটা বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর যতখানি প্রভাব পড়ার কথা, ততখানি পড়েনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী তসলিম এ বিষয়টি উল্লেখ করে প্রশ্ন রাখেন, তাহলে এত টাকা গেল কোথায়? উত্তরটা অবশ্য তিনিই দিয়েছেন, যা এখানে তুলে ধরা হলো।
হতে পারে, মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির প্রভাবটি মূল্যস্ফীতিতে প্রতিফলিত হয় দীর্ঘ সময় পরে। সে ক্ষেত্রে আরও কিছুদিন পর গিয়ে হয়তো মূল্যস্ফীতির হার আরও উচ্চ হবে। তবে এর চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে।
সরবরাহকৃত মুদ্রার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ খাটানো হয়েছে শেয়ারবাজারে। ফলে অর্থগুলো ধাবিত হয়েছে শেয়ারের পেছনে, যা ক্রমান্বয়ে শেয়ারের দাম বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। আর যেহেতু এই অর্থ বাজারে নিত্যপণ্যের পেছনে ধাবিত হয়নি, তাই তা মূল্যস্তরেও সেভাবে প্রভাব ফেলেনি। তাছাড়া বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির নির্ণায়ক যে ভোক্তা মূল্যসূচক, তাতে শেয়ারের দাম অন্তর্ভুক্ত হয় না। ফলে, শেয়ারের দাম অনেক বাড়লেও তা এই সূচকে প্রতিফলিত হয়নি। তাই তা মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে সেভাবে কোনো ভূমিকা রাখেনি।
বলা যেতে পারে, শেয়ারবাজার বিপুল পরিমাণ অর্থ টেনে নিয়ে মূল্যস্ফীতিকে প্রশমিত রাখার ক্ষেত্রে নিজের অজান্তেই কাজ করেছে। তবে এই কাজটি যে টেকসই নয় বা হতে পারে না, তাও ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, শেয়ারবাজার থেকে যখন অর্থ তুলে নেওয়া শুরু হয়েছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তা বাজারকে নিম্নমুখী করেছে। এটা আবার বাজারকে বড় ধরনের সংশোধনের দিকে ঠেলে দেওয়ায় ভূমিকা রেখেছে।
শেয়ারবাজারের এই বিপর্যস্ত অবস্থার পর স্বাভাবিকভাবেই দেশের আর্থিক খাতে একটি বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। কেউ কেউ ভবিষ্যতে গোটা আর্থিক খাতেই বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। সেটা হয়তো ঘটবে না। অন্তত শেয়ারবাজারের এই অবস্থার পর নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট সতর্ক ও দৃঢ় হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁরা তা কতটা হয়েছেন, তা বোঝা যাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রাবিনিময় হারের ক্ষেত্রে অস্থিরতা তৈরি হওয়া বা না হওয়ার ওপর।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger