অসহনীয় বাজার, অসহায় মানুষ

চালের ভরা মৌসুম। অথচ ৩৫ টাকার নিচে বাজারে মোটা চাল নেই। ভাতের পরিবর্তে এক বেলা রুটি খাওয়ার পরিকল্পনা করেও লাভ নেই। চাল ও আটা এখন সমান দরে বিক্রি হয়। শীতের শাকসবজির বাজারও চড়া।

ধান-চালের দাম বাড়ায় কৃষকেরা আগের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন। তবে সবজি বিক্রি করে কৃষকেরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। আটা-ময়দা ও ভোজ্যতেল বিক্রি করে ব্যবসায়ীদের পকেট ফুলে-ফেঁপে উঠছে। আর সবার সামনে অসহায় সাধারণ ভোক্তারা। সীমিত আয়ের মানুষ হতাশ ও অসহায়। তাদের আয়ের বড় অংশই চলে যাচ্ছে দুবেলা পেট ভরাতে।
নিম্নবিত্ত লোকজন দিন দিন ভিড় বাড়াচ্ছে খোলাবাজারে চাল বিক্রির (ওএমএস) ট্রাকের সামনে। ফলে চাল কিনতে আসা মানুষের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মধ্যবিত্তরা পারছে না ট্রাকের সামনে লাইন দিতে। তাই সংকটে তারাই বেশি।
ভরা মৌসুমে চালের দাম কেন বেশি—এ প্রশ্ন সাধারণ মানুষ, বিশেষজ্ঞদের, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও। সরকারের দুই বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে বলেও জানা গেছে।
বরিশাল ছাড়া দেশের বেশির ভাগ এলাকায় আমন ধান কাটা হয়েছে। কৃষক এখন ব্যস্ত বোরোর বীজতলা তৈরিতে। এ সময় বোরোর খরচ তুলতে আমন বিক্রি করেন কৃষক। ফলে বাজারে ধানের জোগান বাড়ে, কমে আসে চালের দর। কিন্তু গত এক সপ্তাহে চালের বাজারে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে।
এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে আরও এক টাকা বেড়েছে। আর আমন কাটা শুরু হওয়ার পর এক মাসে দাম বেড়েছে দুই থেকে তিন টাকা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে বাজারে সবচেয়ে মোটা চালের দাম ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। মাঝারি ৩৮ থেকে ৪২ এবং সরু চাল ৪২ থেকে ৫০ টাকা। সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে ৬ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত।
গতকাল শনিবার খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক রাজধানীর বেশ কিছু স্থানে ওএমএসের চাল বিক্রি কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। ক্রেতারা চালের জন্য সারা দিন দাঁড়িয়ে থেকে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন। খাদ্যমন্ত্রী ট্রাকের সংখ্যা বর্তমানের ১০১টি থেকে বাড়িয়ে ১২৫-এ উন্নীত করা এবং আগামী এপ্রিল মাস পর্যন্ত এ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে আজ খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন কমিটির বৈঠক রয়েছে। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, এ বছর আমনে ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে এক কোটি ৩৫ লাখ টন চাল উৎপাদিত হবে। সম্প্রতি সরকারি মহাকাশবিষয়ক সংস্থা স্পারসো স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি দিয়ে আমনের উৎপাদন এলাকা চিহ্নিত করেছে। স্পারসোর হিসাবে, ৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হিসাবে, আমনে গতবারের চেয়ে উৎপাদন ৩ শতাংশ বেড়েছে।
দেশের বৃহত্তর চালকল রশীদ এগ্রো লিমিটেডের মালিক আবদুর রশীদ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ধান-চালের যে সরবরাহ ও মজুদ রয়েছে, তাতে বাজারে সংকট সৃষ্টির কোনো আশঙ্কা নেই। চাষিদের কাছে প্রচুর চাল মজুদ রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। রাজধানীর বৃহত্তর চালের বাজার বাদামতলী ও বাবুবাজারের চাল ব্যবসায়ীরাও জানিয়েছেন, চালের সরবরাহ যথেষ্ট। দাম বাড়ানো হচ্ছে মূলত মোকামগুলোতে।
ঈশ্বরদী (পাবনা) থেকে মাহাবুবুল হক জানান, উত্তরবঙ্গে চালের অন্যতম বৃহৎ মোকাম ঈশ্বরদীতে গত সাত মাসে ১২ দফা চালের দাম বেড়েছে। এখানকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাল ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মজুদদার ও বড় চাল ব্যবসায়ীরা ব্যাংকঋণ নিয়ে মোকাম থেকে ধান কিনে গুদামে মজুদ করেছেন। ফলে মোকামে ন্যায্য মূল্যে ধান কেনা যায়নি। এর ফলে দুই বছর ধরে ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।
কথা রাখছেন না ব্যবসায়ীরা: সয়াবিন ও পাম তেল মিলিয়ে মাসে এক লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে দেশে। আমদানি পরিস্থিতিও ভালো। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে আন্তর্জাতিক বাজারদর, পরিবহন খরচ, কর, জাহাজভাড়া, ব্যাংক সুদ, যৌক্তিক মুনাফাসহ সর্বোচ্চ খুচরামূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক করে সচিবালয় থেকে বেরিয়ে গিয়েই তা আর মানেন না ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে পাওয়া সূত্রে জানা গেছে, আগামী আড়াই মাস পর্যন্ত ভোজ্যতেলের মজুদ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত ছয় মাসে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে আট লাখ টনের কাছাকাছি। এ ছাড়া টিসিবির হাতেও দেড় হাজার টন সয়াবিন রয়েছে। অর্থাৎ, সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু ভোজ্যতেলের বাজার মোটেই বাগে আনা যাচ্ছে না। তিন দফা বৈঠক করে দুই দফা দাম বাড়ানোর পরও লিটারে আট থেকে ১০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন ও পাম।
সর্বশেষ ২২ ডিসেম্বরের বৈঠক অনুযায়ী, খোলা সয়াবিন তেলের লিটার হওয়ার কথা ঢাকাসহ সারা দেশে সর্বোচ্চ ৯০ টাকা এবং চট্টগ্রামে ৮৮ টাকা। অন্যদিকে খোলা পাম তেল ঢাকায় ৮৬ টাকা এবং চট্টগ্রামে ৮৫ টাকা। খোলা সয়াবিনের তুলনায় পেট বোতলজাত তেলের দর সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ বেশি হতে পারবে। সে হিসাবে বোতলজাত সয়াবিনের দর ঢাকায় হবে প্রতি লিটার ১০১ থেকে ১০২ টাকা।
গতকাল শনিবার ঢাকায় খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৯৬ থেকে ৯৮ টাকা অর্থাৎ, নির্ধারিত দরের চেয়েও আট টাকা বেশিতে। আর বোতলজাত সয়াবিন ১০৫ থেকে ১১০ টাকা দরে।
আবারও দর নির্ধারণ: সরকার চেয়েছিল মাসে একবার নতুন দর নির্ধারিত হবে ভোজ্যতেলের। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম হেরফেরের প্রসঙ্গ তুলে ব্যবসায়ীরা ১৫ দিন পরপর বৈঠক করতে সরকারকে রাজি করিয়েছেন। যদিও ট্যারিফ কমিশন ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে, মাত্র ১৫ দিনের জন্য নির্ধারণ করা দর কার্যকর শুরু হতে হতেই সাত দিন লেগে যায়। আগামী বুধবার আবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দর নির্ধারণের বৈঠক হবে।
ভোজ্যতেলের সার্বিক বিষয়ে তদারক করতে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে গত মাসে। সেই কমিটি আগামী বৈঠকে সুপারিশসংবলিত যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে, দর নির্ধারণে তা বিবেচনায় নেওয়া হবে।
মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষ এখন সবজিমুখী: গরিবের বাজারের তালিকায় এখন মাংস থাকে না। ডিম ও সবজিই তাদের প্রধান খাদ্য। কারণ, এক কেজি গরুর মাংসের দাম ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। গতবার ছিল ২২০ টাকা। আবার এক বছর আগে যে রুই মাছ বিক্রি হয়েছে ১৭০ টাকা কেজি দরে, গতকাল সেই রুই বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৪০ টাকায়। মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ২০ শতাংশ। একইভাবে দেশি মুরগি ২৬ শতাংশ, ইলিশ মাছ ১৬ শতাংশ, খাসির মাংস ১৪ শতাংশ বেড়েছে।
দুবেলা খেয়ে টিকে থাকতে গরিবেরা এখন সবজির দিকে ঝুঁকছে। মধ্যবিত্তরাও একই দলে। গতকাল রাজধানীর গোপীবাগ, মতিঝিল কলোনি বাজার ও কমলাপুর কাঁচাবাজার ঘুরে ক্রেতাদের সবজি কেনার প্রবণতা দেখা গেছে। দুই হাতে সবজি নিয়ে কমলাপুর বাজার থেকে ঘরে ফিরছিলেন ফয়জুন্নেছা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে জানান, ‘ভাতের সঙ্গে তরকারি তো কিছু একটা খেতে হয়। মাছ-মাংস এমনকি মসুর ডালও কেনার মতো সাধ্য নেই।’
চাল-আটা সমান সমান: দেশের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম আটা ও চাল বিক্রি হচ্ছে একই দামে। আটাও এখন সাধারণ মানুষের নাগালের প্রায় বাইরে। এক কেজি মোটা চাল ও এক কেজি আটার দাম এখন সমান। টিসিবির হিসাবে গত এক মাসেই আটার দাম বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। খুচরা বাজারে প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হচ্ছে ৩৩-৩৪ টাকা কেজি দরে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম এখন কমতির দিকে।
এদিকে শুল্ক প্রত্যাহারের পরও চিনির দর কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। টিসিবি ৫৪ থেকে ৫৭ টাকা দরে বিক্রির কথা বললেও সরেজমিনে বাজার ঘুরে দেখা যায়, ভোক্তারা ৬০ টাকার নিচে কেউই চিনি কিনতে পারছে না। অথচ চিনিরও কোনো সরবরাহ ঘাটতি নেই। গত ছয় মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নয় লাখ টন চিনি খালাস হয়েছে।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger