আরজ আলী মাতুব্বর : সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া একজন

বীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন শতবর্ষ পরের কথা, প্রকৃতিও বোধ করি সে হিসাব মিলিয়েছে। বিদ্যাসাগর যখন ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে বই পড়তেন, তার প্রায় শতবর্ষ পরে আরো একজন ফসলের মাঠে দাঁড়িয়ে কিংবা জমির সীমানা মাপতে মাপতে প্রশ্ন করেছেন স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে।

জানতে চেয়েছেন জীবনের গূঢ়তম রহস্যের কথা। বরিশালের ছোট্ট একটি চর লামচরে তাঁর জন্ম হলেও জ্ঞানসাধনা ছাড়িয়ে গেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইল। তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও আরজ আলী মাতুব্বরই অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিয়েছেন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেক জ্ঞানী আর গুণীজনের চেয়ে তিনি আলাদা। সবচেয়ে যে বিষয়টি তাঁকে মানুষের কাছে এনেছে, তা হলো গভীর ভাবনার সহজ প্রকাশ। যেকোনো বিষয়কে চিরায়ত নিয়মে না মেনে যুক্তি দিয়ে দেখা আর অন্তর্ভেদী ব্যাখ্যাদানই ছিল তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি সহজকে তো বটেই; কঠিনকেও ব্যাখ্যা করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। আরো একটি বিষয় হলো পরিমিতি বোধ, যার অভাব এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বড় বেশি। তাঁকে যাঁরা দেখেছেন তাঁরাও বর্ণনা করেছেন এই পরিমিতি শুধু তাঁর ভাবনার প্রকাশে নয়, তাঁর শারীরিক অবয়ব, এমনকি আচরণেও প্রকট। যেন পরিমিতি বোধের এক সমন্বয় হলো আরজ আলী মাতুব্বর নামে স্বশিক্ষিত প্রকৃতির সন্তানের মধ্যে। তিনি প্রকৃতিরই বটে, তা না হলে লামচরের মতো প্রত্যন্ত জনপদে প্রতি মুহূর্তে দরিদ্রতাকে একচোট দেখে নেওয়া, নদীর ভাঙনকবলিত আর দুমুঠো খাবার জোগাড়ের জন্য খেটে মরা এক হতদরিদ্র্র কৃষক কি প্রশ্ন করতে পারেন ঈশ্বর কোথায়? স্বরূপ কী? যে সময়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তার দামও দিয়েছেন হাজতবাসের মাধ্যমে। সারা জীবনের উপার্জন দিয়ে জমি না কিনে তৈরি করেছিলেন গ্রামের মানুষের জন্য পাঠাগার। নদীভাঙনে জমি হারিয়ে কাঁদেননি; কিন্তু সংগ্রহ করা বই নদীতে ভেসে যাওয়ায়, ছেলে হারানোর শোকে শোকার্ত হয়েছেন এ চাষি। সন্মাননাও পেয়েছেন বেশ কিছু, তবে মেডেলের চেয়ে তাঁর বড় প্রাপ্তি মানুষের সম্মান। তবে যত সহজেই তিনি কঠিন কথার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ততটা সহজ ছিল না তাঁর দর্শন-ধর্ম- আত্মউপলব্ধির ভাবনা। শুরুটা ছিল একটি ব্যক্তিগত ঘটনা থেকে। ছবি তোলার অভিযোগে আরজ আলী মাতুব্বরের মৃত মায়ের দাফন করতে রাজি হয়নি গ্রামের মানুষ। প্রায় একঘরে হয়েছিলেন মাতুব্বর আর সেই আঘাত থেকে শুরু হয় কুসংস্কারের স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা। তবে তিনি শোধ নিয়েছিলেন নিজের জীবনেই। যে গ্রামে তাঁর মায়ের কবর দেওয়ার জন্য মানুষ পাওয়া যায়নি, সেই ক্ষুদ্র লামচরের এক অশিক্ষিত কৃষক আরজ আলী মাতুব্বরকে ১৯৮৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ঢল নেমেছিল মানুষের। সেদিনই প্রমাণ হয়ে গেছে, আরজ আলী মাতুব্বর বড় হতে ছাড়িয়ে গেছেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সীমানা। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger