পুঁজিবাজারে অস্থিরতার দায় এসইসির

'পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) শেয়ারবাজার নিয়ে অনভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো আচরণ করেছে। অনভিজ্ঞ ডাক্তার যেমন রোগীকে সকালে হাড় ভাঙার ওষুধ দেওয়ার পর বিকেলে তা বাতিল করে ঠাণ্ডা লাগার ওষুধ দেয়_পুঁজিবাজার নিয়ে তেমনটিই করেছে এসইসি।

তারা সকালে এক সিদ্ধান্ত, বিকেলে অন্য সিদ্ধান্ত দিয়েছে!' গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে অর্থনীতি ও বাণিজ্যবিষয়ক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন। 'মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশ ব্যাংক' শিরোনামে সেমিনারটি আয়োজন করা হলেও তা মূলত শেয়ারবাজারের আলোচনায় রূপ নেয়। সেমিনারে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ, কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. ইব্রাহীম খালেদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
পুঁজিবাজারের অস্থিরতার পেছনে অর্থমন্ত্রীর তেমন ভূমিকা নেই উল্লেখ করে সাবেক গভর্নর বলেন, 'সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অর্থমন্ত্রী সংস্থাটিকে হয়তো পরামর্শ দিয়ে থাকতে পারেন। বাজার অস্থিরতার পেছনে এসইসির দোষ রয়েছে।' কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হলেও ডিসেম্বরে সিআরআর, এসএলআরের হার বাড়ানো ঠিক হয়নি উল্লেখ করে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'কিছু দিন আগে অথবা আগামী মার্চ-এপ্রিল মাসে এসব পদক্ষেপ নিতে পারত কেন্দ্রীয় ব্যাংক।'
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আগে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। অনলাইন পদ্ধতি দোষীদের খুঁজে বের করা খুবই সহজ। ১৯৯৬ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারীদের তখনই শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। বিদেশে এ ধরনের অপরাধের জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'পুঁজিবাজারের এ অস্থিরতার কারণে আর্থিক খাতও ঝুঁকিতে রয়েছে। আর আর্থিক খাতে মড়ক দেখা দিলে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। এ অবস্থা হলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার তেমন কোনো উপায় থাকবে না।' সালেহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, 'ব্যাংকগুলো আমানতকারীর টাকা নিয়ে শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করছে। আমানতকারীর টাকা নিয়ে এ ধরনের ঝুঁঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে যাওয়া ব্যাংকগুলোর উচিত হয়নি। আর মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআর, এসএলআর বাড়িয়ে মুদ্রাবাজার সংকোচন করবে_এটা ঠিক নয়। এতে উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে এসব খাত এমনতিইে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসি নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নিলে পুঁজিবাজারে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না।' সাবেক এই গভর্নর আরো বলেন, 'পৃথিবীর কোনো দেশে ১০০ টাকা ফেসভ্যালুর শেয়ার ১১০ বা ১১৫ টাকার বেশি বিক্রি হতে দেখা যায় না। আর বাংলাদেশে ১০ টাকার ফেসভ্যালুর শেয়ার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়ও বিক্রি হয়!' কেবল আইপিও-নির্ভর না হয়ে বাজারে করপোরেট বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেন তিনি।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এসইসির নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও সার্কুলার পরস্পরকে প্রভাবিত করে উল্লেখ করে সংস্থা দুটির মধ্যে গভীর সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, 'প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও মুদ্রানীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতি দমানো সম্ভব নয়। এজন্য মুদ্রানীতির সঙ্গে আর্থিক নীতির সমন্বয় ঘটাতে হবে। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এখনো ব্যাংকগুলোর আমানত ও ঋণের সুদের হারের পার্থক্য ৫ শতাংশেরও বেশি উল্লেখ করে তিনি তা কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন।'
পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, 'শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থার পেছনে কারা দায়ী, তা সকলেরই জানা। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভবিষ্যতেও পুঁজিবাজার নিয়ে_এমন খেলা খেলবে তারা।'
মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অর্থনীতির বড় অংশ কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে আয় ও কাজ বাড়াতে না পারলে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে যোগসাজশের অর্থনীতি চলছে। এখানে যিনি সংসদ সদস্য, তিনিই রাজনীতিবিদ, তিনিই ব্যবসায়ী, তিনিই ব্যাংকার। তিনিই নীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ধরনের অবস্থা থেকে অর্থনীতিতে মুক্তি দিতে হবে।' মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি মূলত প্রতিবেশী দেশ ভারতের মূল্যস্ফীতি ও বহির্বিশ্বে পণ্যমূল্যের ওপর নির্ভরশীল। কারণ এসব দেশ থেকেই বাংলাদেশকে পণ্য আমদানি করতে হয়। ভারতে মূল্যস্ফীতি বাড়লে বাংলাদেশেও বাড়ে।' তিনি বলেন, 'চলমান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি থাকবেই। তবে তা ৪-৫ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ হলে তা চিন্তার বিষয়। আর তারও বেশি হলে ব্যবস্থা নিতেই হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের বেশি, আর খাদ্যমূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ। এ অবস্থায় ব্যবস্থা না নিয়ে উপায় নেই।'
সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কে কার্যকর করা সম্ভব হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কোনো পণ্য আমদানি করতে হলে ৪০ থেকে ৫০ জনের স্বাক্ষর নিতে হবে। তত দিনে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে।' তাই টিসিবিকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানিতে রূপান্তরের পরামর্শ দেন তিনি।
কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. ইব্রাহীম খালেদ বলেন, 'শেয়ারবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে দোষারোপ করা যৌক্তিক নয়। কারণ বাজারে শেয়ারের দাম যে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল, তা আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করে দিয়েছিল। আর পাঁচটি ব্যাংক নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিল। এর মধ্যে দুই-তিনটি ব্যাংক শেয়ারবাজার নিয়ে অতি বাজে খেলায় মেতেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো উদ্যোগ না নিলে শেয়ারবাজারের সঙ্গে এখন ব্যাংকগুলোও বিপর্যস্ত হতো। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল, আরো আগে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।'
বাংলাদেশের মুদ্রায়ন খুবই নিম্নমানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মুদ্রানীতি মুদ্রাবাজারকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারে না।' মোটামুটিভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশলসহ মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হলে সবাই সন্তুষ্ট হবেন বলে মত দেন তিনি। সেমিনারে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুর রশীদ লালী বলেন, 'বাজারে তারল্য সংকট চলছে। ব্যাংকে গিয়ে ১০ লাখ টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ কয়েক মাস আগেও ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি অলস টাকা পড়ে ছিল। এই টাকা গেল কোথায়?' সেমিনারে ইআরএফ সভাপতি মনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আবু কায়সার প্রমুখ বক্তব্য দেন।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger