হালকা প্রকৌশল শিল্পঃ কারিগরির বিস্ময় ধোলাইখালে

পুরান ঢাকার ধোলাইখালের দিদার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড গাড়ির নানান যন্ত্রাংশ তৈরি করে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মিলবার্ট ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই দিদার ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে যন্ত্রাংশ আমদানির চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ তৈরিও করেছে তারা। নমুনা পরীক্ষা করে সনদও দিয়েছে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক)।

নিউ মিলবার্ট ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী নিশান রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় খুচরা ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেলে তাঁরা প্রতি মাসে ৫০ হাজার ডলারের যন্ত্রাংশ কিনবেন বাংলাদেশ থেকে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক কম্পানিসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানির ইচ্ছা জানিয়ে ই-মেইল
পাঠিয়েছে বিটাকের অতিরিক্ত পরিচালক ড. ইহসানুল করিমের কাছে।
শুধু তাই নয়, ধোলাইখালের এই দিদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উৎপাদিত যন্ত্রাংশের নমুনা সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল। সৌদি আরবের ব্যবসায়ীরা নমুনা দেখে পছন্দ করে ৪৫ দিনের মধ্যে বিপুল পরিমাণ যন্ত্র কেনার প্রস্তাব করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘আমাদের পুরনো প্রযুক্তি দিয়ে এত কম সময়ে বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশ উৎপাদন সম্ভব কি না, তা ভেবে বেকায়দায় আছি।’
এ রকম সাফল্য হালকা প্রকৌশল শিল্পের অনেকেরই রয়েছে। যশোরের একটি প্রতিষ্ঠান লোহা দিয়ে তৈরি করেছে গম থেকে আটা তৈরির মেশিন। এ মেশিন তারা অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানিও করছে। চীন থেকে ইঞ্জিন আমদানি করে ব্যাটারিচালিত গাড়ি তৈরি করেছে বগুড়ার রহিম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। গাড়ির নিজস্ব শক্তি থেকে চার্জ করা ব্যাটারিচালিত এ গাড়ি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। এইচটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নামের অন্য একটি প্রতিষ্ঠান ১৭ বছর আগেই নিফ ভালভ তৈরি করেছে। এটি এখন কাগজ কলের পাল্পের ফ্লো নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজধানীর লালবাগের মাফিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নানা ধরনের কমপ্লিট মেশিনারি তৈরি করছে। এর মধ্যে রয়েছে সিলিং অ্যান্ড কাটিং মেশিন, পিপিপিই ফিল্ম মেকিং মেশিন, রোটারি ডাই সিস্টেম, হিপস অ্যান্ড পিপিসেট মেকিং মেশিন, পেলু প্যাক মেশিন, পাউন্স কাটিং মেশিন।
সফটওয়্যার ছাড়া সাধারণ প্রযুক্তিতে সম্ভব এমন সব ধরনের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশই তৈরি করতে পারেন হালকা প্রকৌশল শিল্পের উদ্যোক্তারা। পাটকলের সব যন্ত্রাংশ, চা প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহƒত সিটিসি মেশিন বাদে সব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, সমিলের ব্লেড বাদে সব যন্ত্র তৈরি হয় ধোলাইখালে। ইস্পাহানি চায়ের সব যন্ত্র ও মেশিন দেশি উদ্যোক্তাদের তৈরি। ধোলাইখালেই তৈরি হচ্ছে ব্যাংকের এটিএম বুথের ঘর। এ ছাড়া পরিবহন সেক্টরের প্রায় সব যন্ত্রই পাওয়া যায় এখানে। আর সেচপাম্প, পাওয়ার পাম্প, পাওয়ার টিলারসহ নানা ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে বগুড়ায়। দেশের চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ মিটিয়ে এগুলো ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও করা হচ্ছে।
ধোলাইখালের নিপুণ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক আবুল হাশিম বলেন, ‘কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চোখের কন্টাক্ট লেন্স আমদানি করে ঢাকার এক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সঙ্গে দেওয়া টু ওয়ে কাটার দিয়ে লেন্স কাটার পরই তা ভেঙে যাচ্ছিল। আমদানিকারকরা বেকায়দায় পড়ে যান। তাঁরা আলোচনা করেন আমার সঙ্গে। আমি লেন্স আমদানিকারকদের আশ্বস্ত করে কয়েক দিন সময় নিয়ে ফোর ওয়ে কাটার তৈরি করে দিই। মহাখুশি হন আমদানিকারকরা। তাঁরা আমাকে বলেন, আপনি নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের কাটার তৈরি করতে দেখেছেন; না হলে কিভাবে ধোলাইখালে বসে এ রকম যন্ত্র তৈরি করলেন আপনি?’
আশির দশকে সরকার শুল্কমুক্তভাবে ডিজেল ইঞ্জিন আমদানির সুযোগ দেয়। স্থানীয় উদ্যোক্তারা ওই ডিজেল ইঞ্জিনকে নৌ (বোট) ইঞ্জিনে রূপান্তর করেন। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সফলতা দেখান হালকা প্রকৌশল শিল্পের উদ্যোক্তারা। তাঁরা সেচপাম্পের ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে থ্রি হুইলার যান তৈরি করেন।
বিইআইওএর সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক জানান, এ শিল্পের মালিকরা যেকোনো যন্ত্র একবার মাত্র দেখেই তৈরি করতে পারেন। বর্তমানে এ শিল্পের উদ্যোক্তারা প্রায় ৩৮ হাজার রকমের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করছেন। এসব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ শিল্প, গৃহস্থালি, কৃষি, বৈদ্যুতিক, যানবাহন, খেলনা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহƒত হচ্ছে। এসবের মধ্যে কাগজ ও সিমেন্ট কারখানার যন্ত্রাংশ, বাইসাইকেল, ফ্যান্সি লাইট ফিটিং, নির্মাণ যন্ত্র, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার, আয়রন চেইন, কার্বন রড, অটোমোবাইল পার্টস, বৈদ্যুতিক ও স্টেনলেস স্টিল ওয়্যার রপ্তানি হচ্ছে। মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হচ্ছে এসব পণ্য।
বিটাক আশা করছে, দেশের হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকে উপযুক্ত প্রণোদনা দিতে পারলে এক দশকের মধ্যেই এটি দেশের প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হবে। জাহাজ ভাঙা লোহা থেকে তৈরি গাড়ির যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রিক পণ্য ও কৃষি খাতের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরির পর তা রপ্তানি করলে মুনাফাও হবে অনেক বেশি।
বিটাকের অতিরিক্ত পরিচালক ড. ইহসানুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিউ মিলবার্টের সঙ্গে রপ্তানি চুক্তি স্বাক্ষরের পাঁচ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক কম্পানিসহ মোট তিনটি প্রতিষ্ঠান টেলিফোন ও ই-মেইলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ থেকে গাড়ির পার্টস আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব দেশ এখন গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে না। তারা মূলত চীন, তাইওয়ান ও ভারত থেকে এসব যন্ত্রাংশ আমদানি করে থাকে। কিন্তু ওই সব দেশের চেয়ে বাংলাদেশ তুলনামূলক কম দামে যন্ত্রাংশ রপ্তানি করতে পারবে।’ তিনি আরো জানান, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কর্মকর্তারাও বাংলাদেশ থেকে গাড়ির পার্টস আমদানির প্রস্তাব করেছেন। কানাডার বেশ কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ড. ইহসানুল করিম বলেন, ‘এসব দেশে যন্ত্রাংশ রপ্তানি করতে পারলে আমাদের আর বাজার খুঁজতে হবে না। ১০ বছরের মধ্যেই গার্মেন্টকে পেছনে ফেলে প্রধান রপ্তানি পণ্যে পরিণত হবে হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং খাত।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) দুই ঊর্ধ্বতন গবেষক নাজনিন আহমেদ ও জায়েদ বখতের ২০১০ সালের জুন মাসে করা ‘লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ : এ কেস স্টাডি’-এর তথ্য অনুযায়ী, এ শিল্পের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ছয় লাখ টাকা থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত। তারা মাত্র দুই থেকে তিন লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করে। ফলে এ শিল্পে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করাও সহজ।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger