কিশোর উপন্যাস : দ্বীনের জ্ঞান অর্জন ।। কামাল উদ্দিন রায়হান

মাহীন। পুরো নাম শফী উদ্দিন মাহীন। পরিবারে মা, দুই ভাই বোন আর সে। বাবা পরলোক গমন করেছেন অনেক আগেই। প্রায় বছর তিনেক হবে। মাহীন পরিবারে সবার বড় ছেলে। বাবা আগে সিএনজি চালাতেন। এছাড়া বড় গাড়ি চালিয়েও উপার্জন করতেন। বর্তমানে সে হাল মাহীনের উপর। মা এবং মাহীনই পরিবারের একমাত্র উপার্জক। মাহীনের পরে তার ছোট ভাই এরপর তার ছোট বোন। সবাই লেখাপড়া করছে। মাহীন প্রতিদিন সকাল আটটায় স্কুলে যায়, ফেরে দুপুর একটায়। বাসায় এসে দু-চারটে ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ে উপার্জনের উদ্দেশ্যে। মাহীনদের বাসার পাশের এক ভদ্র লোকের ভাড়া করা সিএনজি চালায়। প্রতিদিন দুশো টাকা করে দিতে হয় গাড়ির জমা। দিন শেষে মা উচ্চবিত্ত এক পরিবারের ঘরে প্রতিদিন গিয়ে ঝিয়ের কাজ করে। মাহীন এখনমাত্র নবম শ্রেণীতে উঠেছে। ছোট ভাই অন্যএক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে। সবশেষে ছোট বোন তৃতীয় শ্রেণীতে। মাহীন প্রতিদিন রাত নয়টার দিকে বাসায় ফিরে। প্রতিদিন নগদে যা উপার্জিত হয় তা দিয়েই ঘরের যা দরকার তাই খাবার নিয়ে আসে। এরপর সে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে। পড়া চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। পরে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে দুই ভাই বোনকে তাদের স্কুলে এগিয়ে দিয়ে নিজের স্কুলে চলে যায় মাহীন। স্কুলটা বেশি দূরে নয়। বাসা থেকে প্রায় এক কি:মি: মত হবে। বিশাল এলাকা নিয়ে স্কুলটি অবস্থিত। মাহীন নবম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারী একজন ছাত্র। এছাড়াও সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতেও তার রোল এক নম্বরই ছিল। ছাত্রদের কাছে যেমন প্রিয়, শিক্ষকদের কাছে তেমনি প্রিয়। এছাড়া মাহীন দ্বীন ইসলামী শিক্ষা মোটামুটি ভালই পেয়েছে তার মা বাবার কাছ থেকে। তাই ভাল ছেলেদের সাথে মিল রাখাই পছন্দ। শিক্ষকদের মধ্যে হেড স্যার তার সবার চেয়ে প্রিয়। মাহীনের পড়ালেখার সুবিধা, ফ্রি প্রাইভেট শ্রেণীকক্ষের সর্বোচ্ছ সহযোগিতা পেয়েছে এই স্যারের কাছ থেকে। হেডস্যারের নামটিও খুব সুন্দর। নিজাম উদ্দীন। একদিন মাহীনকে এক ছাত্র দিয়ে ডাকলেন হেডস্যারের কক্ষে। মাহীন ডাক শুনে দ্রুত হাজির। Ñ কেমন আছ তুমি? জিজ্ঞাসা করলেন হেডস্যার। Ñ জ্বি স্যার, ভাল। উত্তরে বলল মাহীন। Ñ আমি আর দুদিন তোমাদের কলেজে আছি। এরপর বাইরে চলে যাব। তারপর তোমাদের নতুন শিক্ষক নিয়োগ হবে। মাহীন যেন মাথা ঘুরে পড়ে যাবে অবস্থা।
Ñ কেন স্যার? কান্না জড়িত স্বরে জিজ্ঞাসা মাহিনের। Ñ ওখানে আমার অফিসিয়াল চাকরি হয়েছে। উত্তরে বললেন হেডস্যার। Ñ স্যার, না গেলে হয় না? তাছাড়া আপনিতো সব দিক থেকে এই কলেজকে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। আরও ক’টা বছর থাকেন? প্রশ্ন করে মাহিন। Ñ তোমাদের সব সময় খোঁজ নেব। সুযোগ পেলে এসে দেখে যাব। যাও... বলল হেডস্যার। মাহীনের মন খারাপ। নতুন প্রধান শিক্ষক কেমন হবে? তা ভাবতে লাগল মাহীন। স্কুলে মাহীনের একজন ভাল বন্ধু আছে। নাম নিশাত। প্রতিদিন ওর সাথে হাঁটে, চলে, পড়ালেখা করে। মাহীনের সম্পর্কে নিশাতের সব জানা। তাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে মাহীনকে সাহায্য করা, নিশাতের বাবা বিশাল পয়সাওয়ালা মালিক। মাহীন নিশাতকে অর্থকড়ি সাহায্য না করতে পারলেও তাকে নৈতিক চরিত্র গঠনে ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। নিশাতের মন খারাপ আজ। স্কুলে এসে চুপচাপ। মাহীন তাকে দেখে জিজ্ঞেস করে- কীরে, মন খারাপ মনে হচ্ছে ?
Ñ হ্যাঁ দোস্ত, আমার বন্ধু একজনের নৈতিক চরিত্রের সমস্যার এমনকি ওর পুরো ফ্যামিলির। ছেলেটা যদিও লেখাপড়ায় মোটামুটি ভাল। তারপরও... Ñ হুম, ঠিক আছে। তাকে তুই আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি। আমরা একসাথে ঘুরবো। তারপর কোরআন, হাদীস, ইসলামের কথা বুঝিয়ে দেব। তার নাম? পরিবার সচ্ছল কেমন?
Ñ তানিম, উচ্চবিত্ত পরিবার। উত্তরে নিশাত। মাহীন তার স্কুলের সময় বিরতিতে নিশাত ও তানিম কে নিয়ে ঘুরতো। নিশাতও মাহীন দুজনে ইসলামের নামায ও যাকাত এছাড়াও অন্যান্য জ্ঞান ভাল ভাবে বোঝায়। আস্তে আস্তে তানিম নামাজের প্রতি, ইসলামকে মেনে চলার প্রতি উৎসাহী হয়ে মেনে চলতে শুরু করে। তানিম তার মা কে নামায সম্পর্কে বোঝায় মা কোন রকমই সেটা মাথায় নেয় না। এভাবে দু তিনটা মাস চলে গেল।
নতুন হেডস্যার নিয়োগ হল। এখনো হেডস্যারের সাথে মাহীনের ভয়ে কথা হয়নি। তাছাড়া হেডস্যার নতুন। কাজ গুছিয়ে উঠতে খানিকটা সময় লাগছে। তাছাড়া হেডস্যার নাকি অন্য কোন স্কুলেরও হেড মাষ্টার ছিলেন। মাহীনতো হেডস্যারের নতুন মুখ দেখেই চিনে ফেলল। কলেজ শেষ করে মাহীন বাড়িতে যাওয়ার সময় তার বন্ধু নিশাতের সাথে দেখাÑ আজ তুই ক্লাশে আসিস নাই কেন? প্রশ্ন মাহীনের। Ñ তানিমের আম্মুর অসুখ। উনাকে দেখতে গিয়ে....। উত্তর দিল নিশাত। তানিমের আম্মুর অসুখে তানিমের মন খারাপ। মাহীন সময় না থাকাতে নিশাতকে তানিমের বাসায় ডাক্তার নিয়ে যেতে বলল। এরপর মাহীন বাসায় চলে গেল। নিশাত তানিমকে নিয়ে ডাক্তার আনতে যাবে বলে তানিমের বাসায় যাওয়ার পর দেখে ততক্ষণে ডাক্তার এসে গেছে। ডাক্তার তানিমের আম্মুকে পরামর্শ দিলÑ আপনার ঘাড়ে ব্যাথা। তাই আপনি প্রতিদিন যখন সময় ঘাড়ে গরম পানির সেক দিবেন। আর এই নিন কয়েকটা ঔষধ। আশা করি সারবে। তানিম তার মাকে নামাজের জন্য ওযূ করার নিয়ম দেখিয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু খেয়াল দেননি তাতে। এখন তানিম উৎসাহের সঙ্গে বলে- মা, আমিতো এখন অযূতে প্রতিদিন ঘাড়ে মাসেহ করি তাই আমাদের ঘাড়ে ব্যাথা উঠেনা। তুমিও কর। তানিমের মা যেন নতুন দিশা খুঁজে পেলেন। এখন প্রতিদিন তানিমের মা নামায পড়েন। তাদের পরিবার এখন অনেক ইসলামী মন মানসিকতা সম্পন্ন। মাহীন প্রতিদিনকার মত ভাড়া চালিয়ে এক জায়গায় থামল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল তার স্কুলের নতুন হেডস্যারের দিকে। কোথাও যাবে। তাই হয়তো এখানে দাঁড়িয়ে আছে, ভাবল মাহীন। মাহীন তার সিএনজি এগিয়ে নিয়ে গেল। সালাম দিল- স্যার, কোথায় যাবেন ?
Ñ ওই যে, একটু সামনে যাব। মাহীন স্যারকে নিয়ে চলল। মাহীনের গায়ে তখন ছোট্ট একটা গেঞ্জি। পরনে প্যান্ট। মাথায় টুপি। অবশ্য এরকমভাবেই বেরিয়ে পড়ে প্রতিদিনই। Ñ নাম কী? তুমি পড়ালেখা কর না ? তোমার বাসা কোথায়? তোমার ভাই বোন কজন? একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন করল হেডস্যার। Ñ জ্বি আমি মাহীন। একটি কলেজে পড়ি। আপনি যেখান থেকে উঠেছেন সেখানেই বাসা। আমরা ভাই বোন তিনজন। কথা বলতে বলতে গন্তব্যে চলে আসল হেডস্যার পঁচিশ টাকা এগিয়ে দিল মাহীনের দিকে। Ñ না স্যার, লাগবেনা। বলল মাহীন। Ñ কেন? এই নাও আরও দশ টাকা দিলাম। বলল হেডস্যার। মাহীনকে অনেক কষ্টের পর পঁয়ত্রিশ টাকা ধরিয়ে দিল যদিও মাহীন তা নিতে চায়নি। আস্তে আস্তে মাহীনের বার্ষিক পরীক্ষা চলে আসে। পড়ালেখার ব্যস্ততা বাড়ে। এখন বেশি আয় করতে পারেনা। অনেক কষ্টের পর পরীক্ষা শেষ হয়। মাহীন একটু দুর্বল হয়ে পড়ছে। পড়ালেখা, অন্যদিকে সংসারের হাল টানা তার মত এতটুকু বয়সে কষ্টকর। সপ্তাহ খানেক পরে তার পরীক্ষার ফলাফল দিবে। তারপর সে উঠে যাবে দশমে। ছোট ভাই বোনের ভর্তি। টাকা পয়সাও নেই। শরীরটা বেশ ভাল যাচ্ছেনা। জ্বর আসছে মাহীনের। একদিন ঘুরতে ঘুরতে নিশাত মাহীনের বাসায় আসল। তার ছোট বোন তানিয়াকে দেখে মাহীনের খোঁজ খবর জিজ্ঞাসা করল। Ñ মাহীন ভাইয়ার অসুখ। ভিতরে আসেন। মিষ্টি গলায় বলল তানিয়া। নিশাত সবকিছু শুনে ডাক্তার নিয়ে এল। ছোট ভাই বোনের নতুন ভর্তির খোঁজ নিল নিশাত। পরের দিন নিশাত তার আব্বুর কাছে কথা বলে মাহীনদের ভর্তির জন্য হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে আসে। আস্তে আস্তে সেরে উঠে মাহীন। আগামী কাল রেজাল্ট। সে সাথে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়স্থান অধিকারকারীদের পুরস্কার প্রদান করা হবে। সকালেই নিশাত মাহীনদের বাসায় এসে মাহীনকে নিয়ে গেল। দুজন একত্রে নাস্তা করল। Ñ হেড স্যারের সাথে এখনো আমার ভাল পরিচয় হয়নি। আজ যদি দেখা হয়? বলল মাহীন। Ñ তুইতো ফাষ্ট বয়। আমরাতো লাষ্ট। তোকে স্যারে এমনিইতো ভালবাসবে। আর আজতো তোর মজার দিন। বলতে লাগলো নিশাত।
Ñ ঠিক আছে, এখন চল। দেরী হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। প্রধান অতিথি নতুন হেডস্যার। ফলাফল ঘোষণা শুরু হল। নবম শ্রেণীতে মাহীন পুরস্কার নিতে উঠল মঞ্চে। হেডস্যার মাহীনের দিকে এক পলকে তাকিয়ে রইল। হাতে রেজাল্ট আর পুরস্কার। ঠিক মিনিট দুয়েক হলো। হঠাৎ পরবর্তী ঘোষণা আসতেই সম্বিত ফিরে পেল হেডস্যার। মাহীন সহ অন্যান্যরা তাদের নিজ আসনে গিয়ে বসল। পুরস্কার বিতরণ শেষ। প্রধান অতিথির বক্তব্য শুরু হল। হেডস্যার শুরু থেকে বলতে শুরু করেন, “শিক্ষায় কোন বয়স নাই। আমি নিজে দেখেছি অনেক পিতামাতার অর্থকড়ি আছে বটে! কিন্তু তাদের সন্তানরা ঠিকভাবে পড়ালেখা করে না। মা বাবার অর্থের পেছনে দৌড়ছুটে সন্তানদের ছেড়ে দেন তাদের নিজ আপন মনে। নেই তাদের আর সন্তানদের নৈতিক মান। কারো টাকা পয়সা নেই, দু'মুঠো খাওয়ার জন্য রাস্তাঘাটে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে পরিশ্রম করে পড়ালেখা করে। অনেকের বাবা মা নেই। কিন্তু তাদের পড়ালেখার অবকাশ নেই। তারাই সফল হবে, যারা কষ্টের মাঝেও পড়ালেখা করে।” স্যারের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। স্যার টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন। কথাগুলো সব মাহীনের দিকে তাকিয়ে বলছিল। স্যারের কান্না দেখে মাহীন ও তার বন্ধুদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। নিশাতের বুঝতে অসুবিধা হলোনা হেডস্যারের কথাগুলো কার জন্য বলা।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger