পহেলা বৈশাখ ।। জহির রহমান

সে অনেক আগের কথা,
কয়েক পুরুষ আগের কথা। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যা কিছু দেখতেন, সম্মোহিত হতেন, সবকিছুর সম্মানের কাছে, সব কিছূর শক্তির কাছে তারা নিজেদেরকে নিতান্ত ক্ষুদ্র মনে করতেন। সাপ-বিচ্ছু থেকে শুরু করে বস্তুজগতের এমন কোন শক্তি কিংবা প্রাণের অস্তিত্ব ছিল না যা মানুষের পূজার সামগ্রীতে পরিণত হয় নি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা মানুষের ভেতর সৃষ্টিকরে রেখেছিল শ্রেণীভেদ, একের স্পর্শে অন্যের পবিত্রতা নষ্ট হতো, একের উপস্থিতিতে অন্যের আসবাবপত্র, বাসন কোসন সবকিছু অপবিত্র হতো। তখনকার সমাজে ইশ্বরের বানীও ছিল গুটিকয়েক মানুষের সম্পত্তি, ইশ্বরের বানী শোনার অধিকার ছিল সংরক্ষিত। তাই তো কারো কানে ইশ্বরের বানী ভুলেও পৌঁছুলে তাকে গুনতে হতো চরম মাশুল, গলিত সীসায় বন্ধ করে দেয়া হতো তার কান ।
সে সময়ে,
আরবে এক জোতির্ময় পুরুষ এলেন, যিনি শেখালেন মানুষের প্রকৃত পরিচয়। আর দশটা জীবের মতো মানুষও সাধারণ কোন প্রানী নয় বরং মানুষের পরিচয় হলো মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, আশরাফুল মাখলুকাত। তিনি এসে শোনালেন সাম্যের গান। মানুষে মানুষে নেই কোন ভেদাভেদ, সবাই এক আল্লাহরই বান্দা, তিনি শেখালেন ।
তার আগমনে বিশ্বের কোনে কোনে পরে সাড়া, সে সত্যের স্রোতধারা এক সময় আরব সাগর পারি দিয়ে ভাসিয়ে দেয় বাংলাদেশ। মানুষের তৈরী শ্রেণী বৈষম্যের দেয়াল এতদিন যাদের ইতরের চেয়ে নিম্নস্তরের জানোয়ার বানিয়ে রেখেছিল, সেই মহাপুরুষের অনুসারীদের ভালোবাসায় নিমিষেই ভেঙ্গেপড়ে দাসত্বের শৃংখল। বাংলাদেশের লাঞ্ছিত, সুবিধা বঞ্চিত, নীচু জাতের মানুষেরা দলে দলে শামিল হলেন ইসলামে, ইতর প্রাণী থেকে উঠে এলেন মানুষের কাতারে।

হ্যা, তখন আমাদের সংস্কৃতি ছিল, সে সংস্কৃতি ছিল পূজোর সংস্কৃতি। গাছ, মাটি, পাথর, সূর্য, চন্দ্র, তারা সবকিছুর পুজোয় জড়িয়ে ছিল আমাদের সংস্কৃতি। কৃষি কাজে পুজো, ফসল তুলতে পুজো, নতুন অন্নে পুজো, সবকিছুতেই পুজোর ছড়াছড়ি। সে সংস্কৃতিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সকল শক্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব মেনে নিয়েছিলেন পূর্বপুরুষেরা।  গ্রহণ করেছিলেন ইসলাম, হয়ে ছিলেন মুসলমান, হয়েছিলেন পুতপবিত্র মানুষ।

আজ এতো বছর পরে কেউ কেউ আবার ফিরে পেতে চায় সেই পতিত সংস্কৃতি, যাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সবাই। ফিরে পেতে চান সেই সংস্কৃতিকে যে সংস্কৃতির প্রতিটি নিয়মে ছিল পৌত্তলিকতার গন্ধ। তাইতো আজ বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে পৌত্তলিকতাকে ফিরিয়ে আনায় অবিরাম প্রচেষ্টা। একটি ভাষাকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতি জন্মাতে পারে, তবে বাংলার কোন স্বতন্ত্র সংস্কৃৃতি নেই, বাঙ্গালী সংস্কৃতি নামে পুরোটাই হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতি। পহেলা বৈশাখের  নামে এখানে বাংলা সনের শুরুর দিনের একটা রঙচঙা উৎসব হয় বটে, বলা হয় ওটা সার্বজনীন উৎসব, অথচ ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে ১৯১৭ সালের পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজোর মাধ্যমে শুরু হয় আধুনিক পহেলা বৈশাখের মঙ্গলযাত্রা। পহেলা বৈশাখে হালখাতা পূজা নামে হিন্দুদের আলাদা উৎসব রয়েছে, রয়েছে চৈত্রসংক্রান্তি, শিবপূজা, রয়েছে লোমহর্ষক চরক পূজা।  বাংলা সনের প্রতিটি পার্বনই হিন্দু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানসর্বস্ব। পৌষ সংক্রান্তি , পৌষ পার্বণ এর সবগুলোই হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতি।

যারা মুসলমান তারা একবারও তলিয়ে দেখে না যে ওটা তাদের সংস্কৃতির অংশ নয়, এমনকি বাঙ্গালী সংস্কৃতিও নয়। কেউ যদি বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে হালখাতা পূজো শুরু করতে চায়, হোম কীর্ত্তণ করতে চায়, চৈত্র সংক্রান্তির শিবপূজা করতে চায়, পৌষ পার্বণের নামে দেবতার নামে পিঠে উৎসর্গ করতে চায় তবে সেতো সেই পৌত্তলিকতাকেই গ্রহণ করলো। ইদানিং কট্টর মুসলিমরাও রমনার পার্কে আলাদা ভাবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করে। হিন্দুদের অনুষ্ঠানের চাকচিক্য দেখে এরা এতটাই বিভ্রান্ত যে, যে কোন মূল্যে পৌত্তলিকতাকে ইসলামের নামে গ্রহণ করে জোড়াতালি দিয়ে মুসলমানিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়। এরা মহররমে রথ যাত্রার মতো তাজিয়া মিছিল করে, মঙ্গলযাত্রা করে, হিন্দুরা যেমন দেবতার পায়ের কাছে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালে, এরাও তেমনি মঙ্গলপ্রদীপ জ্বেলে বর্ষবরণ করে।

একজন হিন্দু পূজো করবে এটাই স্বাভাবিক। তার ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধা আছে, ভালোবাসা আছে, তার ধর্মকেই সে শ্রেষ্ঠ মনে করে বলেই পালন করে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। তাই বলে তার ধর্ম-কর্মের জৌলুশ দেখে মুসলমানরাও যদি বিভ্রান্ত হয়, যে কোন মূল্যে সেসব অনুষ্ঠানকে সার্বজনীন অনুষ্ঠান নাম দিয়ে পালন করে, তবে তাতে কেবল ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে তার অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। সার্বজনীন নাম দিলেই যদি সব কিছু জায়েজ হয়ে যায় তবে নাম সর্বস্ব মুসলমানেরা সার্বজনীন দূর্গাপূজাই বা বাদ রাখে কেন, নাকি ওখানেও ওরা ধুপকাঠি নেড়ে নেড়ে ঠিকই আরতী দিয়ে আসে?

অথচ ইসলামের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি রয়েছে। এ সংস্কৃতি সব ধরণের শেরক ও বেদায়াত থেকে মুক্ত। আমরা বাঙ্গলা ভাষাভাষীরা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছি, আরব হই নি, আরব ভাষাকে মাতৃভাষা বলে গ্রহণ করিনি, তাহলে বুঝা যায় ভাষা সংস্কৃতির প্রধান কোন বিষয় নয়। বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের পূর্বে যে সংস্কৃতি ছিল তা ছিল পৌত্তলিক সংস্কৃতি, হিন্দু সংস্কৃতি, বাঙ্গালী সংস্কৃতি নয়। ঠিক তেমনি মুসলমানদের আছে ইসলামী সংস্কৃতি, শেরক বিদয়াত মুক্ত সংস্কৃতি, আরবীয় সংস্কৃতি নয়। আমাদের সংস্কৃতি ভাষা কেন্দ্রিক নয়, তাওহীদভিত্তিক।

তাই যারা বাংলা ভাষা ও ইসলামপূর্ব এ দেশীয় পৌত্তলিক সংস্কৃতিকে গুলিয়ে ফেলেন তাদের একবার ভেবে দেখা উচিত, যে সংস্কৃতি মানুষকে মানবীয় গুণগুলো বিসর্জন দেয়া শেখায়, মানুষে মানুষে শ্রেণীভেদ সৃষ্টি করে, যে সংস্কৃতিতে ইশ্বর গুটিকয়েক লোকের সম্পত্তি হয়ে যায় সে সংস্কৃতিকে বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে আমরা আবার কেন গ্রহণ করবো? ইসলামী সংস্কৃতি যদি ব্যর্থ হয়ে যায়, ইসলামী সংস্কৃতি যদি পৌত্তলিক সংস্কৃতির চেয়ে নিম্নমানের প্রতীয়মান হয় তবে ফিরে যাওয়ার সুযোগ ছিল। অথচ বিশ্বের প্রতিটি জ্ঞানীব্যক্তি মাত্রই জানেন ইসলামের চেয়ে সফল আদর্শ আজো পৃথিবীর কোথাও সৃষ্টি হয় নি। তাহলে একটি সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে আস্তাকুড়ে ফেলে দেয়া সংস্কৃতিকে আবার বুকে তুলে নেয়া কতটুকু যৌক্তিক একবার কি তা ভাবা উচিত নয়?


লেখক : সম্পাদক, মাসিক কিশোর সাহিত্য
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger