কে সাধু, কে শয়তান by মহসীন হাবিব

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মারে এডেলম্যানের একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম 'দ্য পলিটিঙ্ অব মিস ইনফরমেশন' অর্থাৎ, ভুল তথ্যের রাজনীতি। ইংরেজি নাম শুনলেই আমাদের জ্ঞানের জাহাজ মনে করার একটি প্রবণতা আছে। তবে মারের বেলায় এই মনে করার মধ্যে সত্যিই কোনো ভুল নেই।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উইসকিনসন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়িয়েছেন দীর্ঘকাল, রাজনীতি নিয়ে 'দ্য সিম্বলিক ইউসেজ অব পলিটিঙ্'-এর মতো বহু সমাদৃত গ্রন্থ রচনা করেছেন। যাহোক, বিষয় তিনি নন, তাঁর একটি উক্তি। এডেলম্যান তাঁর দ্য পলিটিঙ্ অব মিস ইনফরমেশন গ্রন্থের একটি জায়গায় লিখেছেন, প্রথাগতভাবেই রাজনৈতিক দলগুলো (পলিটিক্যাল গ্রুপস) এবং ব্যক্তিবিশেষ নিজেদের লাভের জন্য অসঠিক তথ্য ছড়িয়ে থাকে।
মারের কথামতো ধরে নেওয়া যাক, অসঠিক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া গণতন্ত্রেরই একটি কৌশল বা অংশ। কিন্তু এর একটি নূ্যনতম মান থাকতে হয়, থাকাটা বাঞ্ছনীয়। এবং একটি গ্রহণযোগ্য মিথ্যা তৈরি করার ক্ষমতাও থাকতে হয়। বাংলাদেশে যে মিথ্যাচার চলে আসছে, তা স্রেফ হ-য-ব-র-ল ধরনের। অত্যন্ত মোটা দাগের মিথ্যাচার। দুঃখের মূল জায়গাটা এখানেই।
এ মুহূর্তে দেশের মানুষ একটি বিভ্রান্তিতে পড়েছে। মানুষ মুখিয়ে আছে একটি সত্য জানার জন্য_সত্যিই কি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ওভাবে নির্যাতন করা হয়েছে? বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'গ্রেপ্তারের পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গায়ে ব্লেডের আঁচড় দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে, পায়ের আঙুল কেটে নেওয়া হয়েছে। সকালে (১৬ ডিসেম্বর) ডিবি অফিস থেকে তাঁকে যখন মেডিকেলে নেওয়া হয়, তখন নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, রক্তে জামা-কাপড় ভিজে যাচ্ছিল।' তিনি এই নির্যাতন ইয়াজিদের ইতিহাসকেও ম্লান করে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। প্রায় একই অভিযোগ করেছেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ও মেয়ে। তবে গণমাধ্যম নিজেরা এ খবরের দায়িত্ব নেয়নি।
উপরিউক্ত বক্তব্য বেশির ভাগ মানুষ কি মেনে নিয়েছে? মানুষ কি মনে করে, সত্যিই তাঁর নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, ব্লেড দিয়ে আঁচড় দেওয়া হয়েছে? আবার তাঁর বক্তব্যের অনেক অংশ জনগণ উড়িয়ে দিতেও পারছে না। কারণ, বাংলাদেশের বিগত দিনের রাজনীতিতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা নেহাত কম নেই। অন্যদিকে, দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তা দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, তিনি একজন সংসদ সদস্য। সেই কথা মাথায় রেখে এবং মানবাধিকারের কথা মনে রেখেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এই বিপরীতমুখী বক্তব্যের নির্লিপ্ত চোখে বিশ্লেষণের ফুরসত আছে বৈকি। বাংলাদেশের পুলিশ অনেক অকাজ-কুকাজের সঙ্গে থাকে_এটা অস্বীকার করার জো নেই। তবে বাস্তবতা যাঁরা জানেন, তাঁরা একমত হবেন, দেশের অনেক সরকারি অফিসের চেয়ে পুলিশ সচেতনভাবে কাগজে-কলমে (যদিও পুলিশের অধিকাংশ কাজ সরেজমিনে; এবং তাদের অপরাধগুলো হয়ে থাকে হাতেনাতে) পরিষ্কার থাকতে চেষ্টা করে। যেমন, দেশে অনেক সরকারি অফিস আছে, যারা এমনকি বরাদ্দকৃত কাগজ-কলম-কালি পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়। ভাউচারে স্বাক্ষর করে মাল সরবরাহ না নিয়ে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসে। পুলিশ কিন্তু এ ক্ষেত্রে এখন অনেকটাই সচেতন। একান্ত চোর জাতীয় অপরাধী ছাড়া পুলিশ যাদের গায়ে হাত তোলে, তাদের ক্ষেত্রে এমন কোনো চিহ্ন রাখে না, যা প্রমাণ করে দেবে, নির্যাতন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তো অনেক বড় ব্যাপার। তাঁকে যদি নির্যাতনই করতে হবে, তাহলে আর যা-ই হোক, পুলিশ ব্লেড দিয়ে আঁচড় দেবে না, তাঁর পায়ের নখ তুলে নেবে না। তাঁর গা দিয়ে রক্ত পড়ছে আর তাঁকে সেই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদালতে_এমন বোকা অন্তত বাংলাদেশের পুলিশ নয়।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে অন্যদের বেলায় এমন অভিযোগ না উঠে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বেলায় উঠল কেন? এর উত্তর হলো, সাকা চৌধুরীর প্রতি সহানুভূতি তৈরির আর কোনো পথ পৃথিবীর বুকে খোলা নেই।
সম্ভাবনা একটি থেকে যায়। আর তা হলো, অতি উৎসাহী কেউ তাঁকে চোরাগোপ্তা ব্লেড মারল কি? সরকারকে খুশি করতে গিয়ে কেউ তাঁর গায়ে হাত তুলে আশীর্বাদ পেতে চাইল? না, সেখানেও কিছু কথা আছে। তিনি এতটাই কড়া নিরাপত্তার ভেতর ছিলেন যে, একা একা এ কাজ কারো দ্বারা করা সম্ভব নয়।
তবে ঘটনা যেটাই হোক, এ বিষয়ে যে পক্ষই দেশবাসীর সামনে মিথ্যাচার করুক, তারা একটি ভয়ানক অমার্জনীয় অপরাধ করছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হোক, সেখানে বিচার যা হওয়ার হবে। কিন্তু তাঁকে ঘিরে যে মিথ্যাচার চলছে, তা জাতির ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য হতাশাজনক প্রভাব ফেলবে।
তবে ব্যক্তি সালাহউদ্দিন চৌধুরীর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ১৯৬৬ সালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ নটর ডেম কলেজের আই এ ক্লাসের ছাত্র। তখন নটর ডেমের শিক্ষক ছিলেন রেভারেন্ড রিচার্ড ডবি্লউ টিম। সর্বমহলে তিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম প্রেমিক ফাদার টিম হিসেবে পরিচিত। একদিন টিম ছাত্রদের মনোযোগ দিয়ে পড়াচ্ছেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি ছেলে ভয়ানক চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। ফাদার টিমের মতো শান্ত স্বভাবের মানুষটি রাগান্বিত হলেন এবং বারান্দায় গিয়ে ছেলেটির কবজি শক্ত করে ধরে বললেন,...

ফাদার টিম তাঁর স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থে ------ এ কথাটি লিখেছেন। ১৯৮৫ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রিসভায় থাকাকালে সাকা চৌধুরী এ কাহিনী ফাদার টিমকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
টিমের কথা তিনি রাখেননি। গত ১৬ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত সাকা চৌধুরী তাঁর মুখ থামাননি। বহুবার তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে কটাক্ষ করার মতো ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছেন, যা দেশের সাধারণ মানুষ এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। আর এ কারণেই হয়তো বিএনপি ছাড়া অন্য কাউকে সাকা চৌধুরীকে নিয়ে মাথাব্যথা লক্ষ করা যাচ্ছে না। তাঁকে নিয়ে কৌতূহল আছে, কিন্তু উদ্বেগ নেই। বরং দেশের মানুষ মুখিয়ে আছে, এরশাদের মন্ত্রী এবং বিএনপির মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা থাকা অবস্থায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে কী কী ঘটিয়েছেন, তা থলে থেকে বের হওয়ার অপেক্ষায়।
একটি কথা পরিশেষে না বললেই নয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ চলেছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সরলমনা রাজনীতি দিয়ে। বঙ্গবন্ধু ভালোবাসা, ব্যক্তিগত অধিকার, প্রেম এবং আদরের ধমক দিয়ে দেশের মানুষের উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন (যদিও কোন পথে দেশ উন্নতি করবে, তার উপায় জানা ছিল না), যা এক অর্থে দুর্বলতা। কারণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো_রাজনীতিতে থাকবে কূট কৌশল-নিষ্ঠুরতা। বিশ্বাস দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করা রাজনৈতিক সমাজের কাছে হাস্যকর। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে কুটিল রাজনীতি এ দেশে শুরু হয়, তার সঙ্গে বাঙালির কখনো পরিচয় ছিল না। যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই পাকিস্তান নিষ্ঠুর ছিল, অবিবেচক ছিল_এত ধূর্ততা দেখাতে পারেনি। অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে একটি মাত্র উল্লেখ করা যাক। আজ যেখানে শিশুপার্ক করা হয়েছে, সেই জায়গাটি মুজিবনগরের মতো একটি ঐতিহাসিক স্থান। ওখানেই আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। সেখানে থাকার কথা ছিল হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের একটি স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেখানে অতি কৌশলে নির্মাণ করা হয়েছে শিশুপার্ক। এই শিশুপার্ক ভাঙবে কে? শিশুদের মতো নিষ্পাপ সম্প্রদায়কে রাজনীতিতে ব্যবহারের কী কঠিন কৌশল!
অতীতে অনেক জাতীয় নেতাকে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য খেসারত দিতে হয়েছে, যা দেশের সব মানুষের ধারণায় আছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কিসের খেসারত দেবেন কিংবা দেবেন না, তা দেখার অপেক্ষায় এখন দেশ।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger