সমস্যার শেষ নেই বস্তির নারীদের by ইয়াসমিন পিউ

রাজধানীর রেললাইনের পাশ ধরে দীর্ঘ লাইনে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় বেশ কিছু বস্তি। নানা সমস্যা নিয়ে এখানে মানবেতর জীবন যাপন করছে নিম্ন আয়ের মানুষ। নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত প্রায় ২০টি বস্তিতে বসবাস তাদের। খড় আর পলিথিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি ঘরের বাইরে একচিলতে মাটিতে চুলায় রান্না করছেন মালতি বেগম। অন্ধকার ঘরে কেরোসিনের কুপির আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে মালতির নাকফুল।
বস্তির পাশেই একটি মেসে কাজ করে সে। সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা গেছে আরো বছর পাঁচেক আগে। স্বামীর শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ধরে রেখেছেন পাঁচ রতি স্বর্ণের নাকফুলটি। সারাদিন এ বাসা থেকে ও বাসায় কাজ করলেও কোন বাসায় তাকে খাবার খেতে দেয় না। সন্ধ্যায় ঝুপড়ি ঘরে ফিরে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রান্না করে খান মালতি। পরনে তার ছেঁড়া ময়লা শাড়ি, ঘরে নেই শীত নিবারণের কাঁথা। তবুও বেঁচে থাকা; স্বপ্ন একটাই-'হয়তো ফুরাবে দুর্দিন।'
বস্তির নারীদের সমস্যার শেষ নেই। ২৪ বছরের নূরজাহান বলেন, বস্তিতে কোনদিন গাও ধুইতে (গোসল) পারি না। মাইনষের বাড়ি কামত গেইলে সেইখান থাকি গাও ধুইয়া আসি। এই বয়সে নূরজাহানের তিনটি সন্তান; শরীর শুকিয়ে গড়ন হয়েছে কঙ্কালের মতো। সন্তানগুলোও ভালো নেই; ভুগছে অপুষ্টিতে। মুখে ঘা, সর্দি আর কৃমিভর্তি মোটা পেট দেখে সহজেই বোঝা যায় কতটা অসহায় এই শিশুরা। চিকিৎসা নেই, ওষুধ নেই, তারপরেও বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা।
বস্তিতে উঠতি বয়সের মেয়েরা ভোগেন চরম অনিরাপত্তায়। সন্ধ্যা হতেই বিভিন্ন মাদকদ্রব্য কিনতে আসা সন্ত্রাসীদের হাতে অহরহ হতে হয় লাঞ্চিত। ১৭ বছরের শিউলী বলে, সাদাসেবি ব্যাটারা সন্ধ্যায় যখন বস্তিতে আসে, আমরা মাইয়্যারা তখন ঘরে বাতি নিভাইয়া চুপ মাইরা থাকি। সন্ধ্যার মধ্যে ঘরে আইতে না পইলে একলা আর আসন যায় না। তখন বস্তির কাকা-মামারা রাস্তা থাইক্যা ঘরে আইনা রাইখ্যা যায়।
জাতিসংঘের জরুরি শিশু সহায়তা তহবিল (ইউনিসেফ) ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি ১০ লাখ মানুষ শহরাঞ্চলে বাস করে। এর মধ্যে বস্তিতে থাকে প্রায় ৭০ লাখ। এসব বস্তিবাসীর অবস্থা গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে খারাপ। বস্তি এলাকায় পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃতু্যর হার গ্রামের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। বস্তিতে শিশুশ্রমিকের হার জাতীয় হারের তিনগুণ বেশি। গ্রামে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা সুবিধা পায় ৫৪ শতাংশ মানুষ। অথচ বস্তিতে এই সুবিধা পায় মাত্র নয় ভাগ মানুষ।
বস্তির নারীদের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বেহাল অবস্থা। জীর্ণ-শীর্ণ শরীরের একেকজন নারীর কমের পক্ষে তিন-চারটি সন্তান। মেয়ে শিশুদের মধ্যে বাল্য বিয়ের প্রবণতা যেমন বেশি, তেমনি অপুষ্টিতে জন্ম নেয়া শিশুমৃতু্যর হারও বেশি। জন্মনিয়ন্ত্রণের মাঠকর্মী এখানে আসে কিনা জানতে চাইলে ২০ বছর বয়সী স্বপ্না বেগম বলেন, কেউ আসে না, আর জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি কই পাওয়া যায় তাও আমরা জানি না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বস্তির জনগণকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম এবং দক্ষ করে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তারা বলেন, শুধু নির্বাচনের সময় বস্তির লোকদের মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু অন্য সময় তাদের খোঁজ নেয়া হয় না। এভাবে হলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়নের চেষ্টা করা হলে তা হবে বৃথা।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger