শিশুদের পঙ্গু করে নামানো হচ্ছে ভিক্ষায়

ট-নয় বছরের এক শিশুকে জড়সড় করে আটকে রাখা হয়েছিল অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলের ভেতর। টানা ছয় মাস। খাবার বলতে দিনে একবার সামান্য ভাত অথবা রুটি আর পানি। এতে দিনে দিনে শিশুটি হয়ে পড়ে কঙ্কালসার। এরপর তাকে ভাড়া দেওয়া হয় ভিক্ষাবৃত্তিতে।

শিশুদের নিয়ে এমন ঘৃণ্য ব্যবসা জমিয়ে তুলছে একটি সন্ত্রাসী চক্র। তারা শুধু শিশুদের পাতিলের ভেতরই রাখছে না, কারও হাত কেটে দিচ্ছে, কারও পায়ের রগ কেটে পঙ্গু করছে। র্যাব কর্মকর্তারা গতকাল বুধবার এক বিশেষ অভিযান চালিয়ে এ চক্রের সদস্য শরিফুল ইসলাম ওরফে কোরবানকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারের পর সাংবাদিকদের সামনে এসব অপকর্মের কথা স্বীকার করেন কোরবান।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, পথেঘাটে এমন কঙ্কালসার শিশু দেখে হূদয়বান মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, সাহায্য করছেন। কিন্তু তাঁরা জানেন না, সে অর্থ চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসী চক্রের হাতে। ভয়ংকর এ সন্ত্রাসী চক্রের আস্তানাটি গড়ে উঠেছে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের আশ্রাফাবাদে।
শিশুদের নিয়ে ব্যবসা ফাঁদার এই নিষ্ঠুর ও ঘৃণ্য চক্রের সঙ্গে জড়িত এক সদস্যকে গ্রেপ্তারের খবর জানাতে গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে র্যাব। সংবাদ সম্মেলনে এ চক্রের সর্বশেষ শিকার শিশু নিয়ামুল ও তার দরিদ্র মাকে হাজির করা হয়। শিশুটি তার ওপর নির্যাতনের ভয়াবহ বিবরণ দেয়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও জনসংযোগ শাখার পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল বলেন, একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানের সূত্র ধরে তাঁরা এ চক্রের সন্ধান পান। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এলিনা খান ও ব্ল্যাক ট্রুথ প্রডাকশনস সেন্টারের পরিচালক অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন। তাঁরা অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এ চক্রের হদিস পান। তাঁদের অনুষ্ঠানে ওই চক্রের হোতারা তাদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে। এরপর তথ্য-প্রমাণসহ অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা বিষয়টি র্যাবকে জানান। গতকাল রাজধানীর উত্তরা এলাকার ১২ নম্বর সেক্টর থেকে কোরবানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। সংবাদ সম্মেলনে টিভি অনুষ্ঠানের দুই আয়োজকও উপস্থিত ছিলেন।
র্যাবের পরিচালক বলেন, কামরাঙ্গীরচরের এ চক্রের মূল হোতা ওমর ফারুক নামের এক সন্ত্রাসী। কামরাঙ্গীচরের আশ্রাফাবাদে তাঁর একটি ক্লাবঘর আছে। সেখানেই এসব অপকর্ম চলে। ওমর ফারুকের সঙ্গে আছে সালাউদ্দিন, এমরান, রাসেল, রনি, সাদ্দাম, কাওসারসহ কয়েকজন। এরা ওমর ফারুকের নির্দেশে ছিনতাই করে। আর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো শিশুদের দেখলেই তাদের ধরে নিয়ে যায়। এরপর সেই শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তির ‘উপযোগী’ করতে পঙ্গু করা হয়।
র্যাব পরিচালক জানান, গ্রেপ্তার হওয়া কোরবান স্বীকার করেন যে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের কাজ করে আসছে। এর মধ্যে ২০০৪ সালে শরীফ নামের এক বালককে তারা কামরাঙ্গীরচরের বেড়িবাঁধে নিয়ে হাতের কবজি কেটে পঙ্গু করে দেয়। এরপর তাকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। শরীফের বাড়ি কোথায়, তা তারা জানে না। তবে সে খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলত। ২০০৬ সালে রাহাত নামের আরেক শিশুকে তারা পায়ের রগ কেটে দেয়। রাহাতের বাড়ি যশোরে। ২০০৮ সালে অজ্ঞাতনামা একটি শিশুকে তারা ছয় মাস একটি পাতিলের মধ্যে আটকে রাখে। পরে তাকে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষায় ভাড়া দেওয়া হয়। কোরবান জানান, এ চক্রের সর্বশেষ শিকার ছিল নিয়ামুল। দরিদ্র রিকশাচালক উমেদ আলীর ছেলে নিয়ামুলকে তারা এ বছরের ৬ সেপ্টেম্বর অপহরণ করে। এরপর ব্লেড দিয়ে তার পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে, গলা ও বুকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। কিন্তু একপর্যায়ে শিশুটি মারা গেছে বলে মনে করে তারা তাকে ফেলে দিয়ে চলে যায়।
সংবাদ সম্মেলনে ব্ল্যাক ট্রুথ প্রডাকশনস সেন্টারের পরিচালক অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী বলেন, টিভি অনুষ্ঠান করতে গিয়ে তাঁরা শিশুটির এ ভয়ংকর ঘটনার হদিস পান। তাঁরা জানতে পারেন, আহত শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে খবর পেয়ে চক্রের সদস্যরা নিজেরাই আসামি ও বাদী সেজে কামরাঙ্গীরচর থানায় একটি সাজানো মামলা করে। পরে নিজেরা আপস করেছে বলে সেই মামলা তুলে নেয়। কিন্তু শিশু নিয়ামুল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার বাবা উমেদ আলী এ নিয়ে মামলা করতে গেলে থানা আর মামলা নেয়নি। পরে তাঁরা আদালতে যান। তিনি বলেন, ঘটনার এখানেই শেষ নয়। সন্ত্রাসী চক্রের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার পর সন্ত্রাসীরা আরেকটি সাজানো মামলা করে শিশুটির পিতা ও তাঁর মামলার সাক্ষীদের আসামি করে। এ মামলায় তারা অভিযোগ করে, র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কোরবানকে অপহরণ করা হয়েছে। রাজধানীর কদমতলী থানার পুলিশ সেই মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তারও করে। শিশুটির বাবা এখন এই সাজানো মামলার আসামি।
হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এলিনা খান অভিযোগ করেন, এ চক্রের সঙ্গে কদমতলী ও কামরাঙ্গীরচর থানার পুলিশের সখ্য আছে। তারা প্রকৃত নির্যাতনকারীর মামলা না নিলেও সাজানো মামলা নিয়ে আসামি গ্রেপ্তার করেছে। তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করে আসামি ধরতে অনুরোধ করা হলেও তারা সহযোগিতা করেনি।
গ্রেপ্তার হওয়া কোরবান সাংবাদিকদের জানান, এ সন্ত্রাসী চক্রের সদস্য আট-নয়জন। তাদের নেতা ওমর ফারুক। সবকিছু হয় তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। দলের সবাই তাঁর কথামতো সবকিছু করে। কামরাঙ্গীরচরের আশ্রাফাবাদ নতুন গলিতে স্কুলের ডান পাশে ওমর ফারুকের ক্লাবঘর। ওমর ফারুক এলাকায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত। তিনি দিনের বেলায় ঘুমান। সন্ধ্যার পর ক্লাবে এসে এলাকার বিচার-সালিসের নামে চাঁদাবাজি করেন। আর রাতের কারবারের হিসাবনিকাশ নেন। ভোরবেলা ঘুমাতে যান। কত শিশুকে নির্যাতন করে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামানো হয়েছে, তার সঠিক হিসাব তিনি জানেন না। তবে সংবাদ সম্মেলনে ‘কয়েকটি ঘটনা মনে পড়ছে’ বলে উল্লিখিত ঘটনাগুলোর বিবরণ দেন।
Share this post :

Post a Comment

Test Sidebar

 
Support : Creating Website | Johny Template | Mas Template
Copyright © 2011. BdNewsTest - All Rights Reserved
Template Created by Creating Website Published by Mas Template
Proudly powered by Blogger